আজম খান, গেরিলা থেকে সুরেলা

আজম খান, গেরিলা থেকে সুরেলা

”একরাতে রুমীর সেন্ট্রি ডিউটি পড়েছিল কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে। অনেক রাতে টিলার মাথায় রুমী দাড়িয়েছিল। চারধারে ছোটবড় আরো কয়েকটা টিলা, এদিক-ওদিক বড় বড় গাছ।

রুমী বলছিল, ‘জানো আম্মা, ওখানে তো সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। সারা দিনের প্রচন্ড খাটনিতে সবাই এ্যাতো টায়ার্ড থাকে যে আটটা ন’টার মধ্যে বেশির ভাগ ছেলে ঘুমিয়ে যায়। দু’একটা তাঁবুতে হয়ত কেউ কেউ আরো খানিকক্ষণ জেগে গানটান গায় কিংবা আড্ডা দেয়। সে রাতে টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কি, একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থকে ভেসে আসছে গানের সুরঃ
হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ।

বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গানের গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। সেদিন সেই রাতে চারদিক ভীষণ অন্ধকার, অন্যসব ব্যারাক আর তাঁবুর সবাই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ন’টা-দশটাতেই মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। ঐ একটা তাঁবুর ভেতর হারিকেনের আলো ছড়িয়ে সাদা রঙের পুরো তাঁবুটা যেন ফসফরাসের মতো জ্বলছে। উঁচু থেকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল অন্ধকার সমুদ্রে যেন একটা আলোকিত জাহাজ। আর আজম খানের গানের সুর, মনে হচ্ছিল যেন চারদিকেই ইথারে ভেসে ভেসে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ছে। তখন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।”

-একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম

বাংলাদেশ আর আজম খানের ইতিহাস সমান্তরালে এগিয়েছে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আজম খান ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে দেশের তরুণ সমাজকে উদ্দীপিত করেছিলেন।

৭১ সালে যখন বর্বর পাকিস্তানীরা নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, গণহত্যা আর গণধর্ষনের তান্ডবে মেতে উঠলো, আজম খান সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে চলে গেলেন আগরতলায়। মেলাঘরে প্রশিক্ষণ নিলেন মুক্তিযুদ্ধের।

পাহাড়ি রুক্ষ মেলাঘর, থাকার খাবার ভীষণ অসুবিধা, তার মধ্যে কঠোর প্রশিক্ষণ… তবু তরুণেরা সব সইছে দেশমাতৃকার জন্য জীবন দেবার অপেক্ষায়। সেই সময়ে প্রতিরাতে পুরো ক্যাম্পে ছড়িয়ে যেতো আজম খানের কণ্ঠের গান। গান গেয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার দায় তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে।

প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে যোগ দেন সম্মুখ যুদ্ধে। বিখ্যাত হালদা যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

তারপর আবার তাঁকে আগরতলায় ডেকে পাঠানো হয়। খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের কমান্ডার করে আজম খানকে দেওয়া হয় ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশনের দায়িত্বে। যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করতে থাকেন একের পর এক। নেতৃত্ব দেন “অপারেশন তিতাস” এর। গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, পূর্বাণী প্রভৃতির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেগুলোতে অবস্থানরত বিদেশীদের জানিয়ে দেন বাংলাদেশে কোনো ’গণ্ডগোল’ না, ’মুক্তিযুদ্ধ’ চলছে। মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে আবারো সম্মুখ যুদ্ধ হয় আজম খানের নেতৃত্বাধীন গেরিলা ইউনিটের। জয়ী হয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আজম খান ঢাকায় প্রবেশ করেন।

যুদ্ধে বাঁ কানে আঘাত পান, তারপর থেকে আজীবন ভালো শুনতে পেতেন না। তবু গান থামেনি।

যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে তরুণ প্রজন্ম যখন খুব দ্রুতই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলো, তখন আজম খানের মনে হলো এই তারুণ্যকে কোনো একটা আনন্দের সঙ্গে যুক্ত করা না গেলে এরা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে।

মুক্তিযুদ্ধকালে যেভাবে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন, যুদ্ধের পরও আবার কণ্ঠে তুলে নিলেন গান। নতুন ধরনের গান। গেয়ে ওঠেন সালেকা মালেকা আর আলাল দুলালদের গান, রেল লাইনের বস্তিতে সন্তানহারা মায়ের কান্না তুলে আনেন গিটারের ছয়তারে, হারিয়ে যাওয়া অভিমানীকে খুঁজে ফেরেন গানে গানে আর পেয়েও হারিয়ে ফেলার আর্তনাদে ভরে তোলেন বাংলা গানের আকাশ…

বাংলা গান পায় নতুন এক প্রাণ স্পন্দন!

এতোদিন পপ সঙ্গীত ছিলো ফাইভ স্টার হোটেলের জলসায়, বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপার। বিদেশী ভাষায়। আমসাধারণের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলো না।

আজম খান সেই পপ সঙ্গীতকে নিয়ে এলেন বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে, সাধারণ মানুষের মাঝখানে, তারুণ্যের হৃদয়ে। হতাশায় নিমজ্জিত তারুণ্য পেলো নতুন উদ্দাীপনা… পরের দশকে যা বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। পাঁচতারা হোটেল আর ইংরেজি গান ছেড়ে ফিডব্যাক নেমে আসে বাংলার মাটিতে, মন শুধু মন ছুঁয়েছে গেয়ে সারা দেশ মাতিয়ে তোলে সোলস। তারপর তো এলআরবি, মাইলস, ফিলিংস (পরবর্তীতে নগরবাউল), রেনেসাঁ… শুরু হয় বাংলার নতুন রেনেসাঁ। লাকী আখান্দ, হ্যাপী আখান্দ, নয়ন মুন্সী, মাকসুদ, নিলয় দাশ, আইয়ুব বাচ্চু, হামিন, শাফিন, নকীব খান… আরো কতো কতো নাম আজ উজ্জ্বল তারকা হয়ে দিপ্তী ছড়ায়…

এই ছায়াপথের সবচেয়ে উজ্জ্বল আর পথ প্রদর্শক তারকা আজম খান ৯ বছর আগে আজকের দিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন…

অসীম শ্রদ্ধা গুরু”একরাতে রুমীর সেন্ট্রি ডিউটি পড়েছিল কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে। অনেক রাতে টিলার মাথায় রুমী দাড়িয়েছিল। চারধারে ছোটবড় আরো কয়েকটা টিলা, এদিক-ওদিক বড় বড় গাছ।

রুমী বলছিল, ‘জানো আম্মা, ওখানে তো সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। সারা দিনের প্রচন্ড খাটনিতে সবাই এ্যাতো টায়ার্ড থাকে যে আটটা ন’টার মধ্যে বেশির ভাগ ছেলে ঘুমিয়ে যায়। দু’একটা তাঁবুতে হয়ত কেউ কেউ আরো খানিকক্ষণ জেগে গানটান গায় কিংবা আড্ডা দেয়। সে রাতে টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কি, একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থকে ভেসে আসছে গানের সুরঃ
হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ।

বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গানের গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। সেদিন সেই রাতে চারদিক ভীষণ অন্ধকার, অন্যসব ব্যারাক আর তাঁবুর সবাই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ন’টা-দশটাতেই মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। ঐ একটা তাঁবুর ভেতর হারিকেনের আলো ছড়িয়ে সাদা রঙের পুরো তাঁবুটা যেন ফসফরাসের মতো জ্বলছে। উঁচু থেকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল অন্ধকার সমুদ্রে যেন একটা আলোকিত জাহাজ। আর আজম খানের গানের সুর, মনে হচ্ছিল যেন চারদিকেই ইথারে ভেসে ভেসে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ছে। তখন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।”

-একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম

বাংলাদেশ আর আজম খানের ইতিহাস সমান্তরালে এগিয়েছে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আজম খান ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে দেশের তরুণ সমাজকে উদ্দীপিত করেছিলেন।

৭১ সালে যখন বর্বর পাকিস্তানীরা নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, গণহত্যা আর গণধর্ষনের তান্ডবে মেতে উঠলো, আজম খান সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে চলে গেলেন আগরতলায়। মেলাঘরে প্রশিক্ষণ নিলেন মুক্তিযুদ্ধের।

পাহাড়ি রুক্ষ মেলাঘর, থাকার খাবার ভীষণ অসুবিধা, তার মধ্যে কঠোর প্রশিক্ষণ… তবু তরুণেরা সব সইছে দেশমাতৃকার জন্য জীবন দেবার অপেক্ষায়। সেই সময়ে প্রতিরাতে পুরো ক্যাম্পে ছড়িয়ে যেতো আজম খানের কণ্ঠের গান। গান গেয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার দায় তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে।

প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে যোগ দেন সম্মুখ যুদ্ধে। বিখ্যাত হালদা যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

তারপর আবার তাঁকে আগরতলায় ডেকে পাঠানো হয়। খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের কমান্ডার করে আজম খানকে দেওয়া হয় ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশনের দায়িত্বে। যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করতে থাকেন একের পর এক। নেতৃত্ব দেন “অপারেশন তিতাস” এর। গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, পূর্বাণী প্রভৃতির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেগুলোতে অবস্থানরত বিদেশীদের জানিয়ে দেন বাংলাদেশে কোনো ’গণ্ডগোল’ না, ’মুক্তিযুদ্ধ’ চলছে। মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে আবারো সম্মুখ যুদ্ধ হয় আজম খানের নেতৃত্বাধীন গেরিলা ইউনিটের। জয়ী হয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আজম খান ঢাকায় প্রবেশ করেন।

যুদ্ধে বাঁ কানে আঘাত পান, তারপর থেকে আজীবন ভালো শুনতে পেতেন না। তবু গান থামেনি।

যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে তরুণ প্রজন্ম যখন খুব দ্রুতই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলো, তখন আজম খানের মনে হলো এই তারুণ্যকে কোনো একটা আনন্দের সঙ্গে যুক্ত করা না গেলে এরা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে।

মুক্তিযুদ্ধকালে যেভাবে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন, যুদ্ধের পরও আবার কণ্ঠে তুলে নিলেন গান। নতুন ধরনের গান। গেয়ে ওঠেন সালেকা মালেকা আর আলাল দুলালদের গান, রেল লাইনের বস্তিতে সন্তানহারা মায়ের কান্না তুলে আনেন গিটারের ছয়তারে, হারিয়ে যাওয়া অভিমানীকে খুঁজে ফেরেন গানে গানে আর পেয়েও হারিয়ে ফেলার আর্তনাদে ভরে তোলেন বাংলা গানের আকাশ…

বাংলা গান পায় নতুন এক প্রাণ স্পন্দন!

এতোদিন পপ সঙ্গীত ছিলো ফাইভ স্টার হোটেলের জলসায়, বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপার। বিদেশী ভাষায়। আমসাধারণের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলো না।

আজম খান সেই পপ সঙ্গীতকে নিয়ে এলেন বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে, সাধারণ মানুষের মাঝখানে, তারুণ্যের হৃদয়ে। হতাশায় নিমজ্জিত তারুণ্য পেলো নতুন উদ্দাীপনা… পরের দশকে যা বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। পাঁচতারা হোটেল আর ইংরেজি গান ছেড়ে ফিডব্যাক নেমে আসে বাংলার মাটিতে, মন শুধু মন ছুঁয়েছে গেয়ে সারা দেশ মাতিয়ে তোলে সোলস। তারপর তো এলআরবি, মাইলস, ফিলিংস (পরবর্তীতে নগরবাউল), রেনেসাঁ… শুরু হয় বাংলার নতুন রেনেসাঁ। লাকী আখান্দ, হ্যাপী আখান্দ, নয়ন মুন্সী, মাকসুদ, নিলয় দাশ, আইয়ুব বাচ্চু, হামিন, শাফিন, নকীব খান… আরো কতো কতো নাম আজ উজ্জ্বল তারকা হয়ে দিপ্তী ছড়ায়…

এই ছায়াপথের সবচেয়ে উজ্জ্বল আর পথ প্রদর্শক তারকা আজম খান ৯ বছর আগে আজকের দিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন…

অসীম শ্রদ্ধা গুরু

[গুরু আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ০৫ জুন ২০২০ তারিখে ফেসবুকে লেখা ও বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকমে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus