সাদাকালো ক্যারমগুটি, বরিক পাউডার, ভূতের চেহারা, পুকুরে অবিরাম ডোবাডুবি, ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফেরা, চোরের মতো বাড়ি ঢোকা, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান বাবার মধুর বকুনি ‘এই বয়সে এইসব করা ভালো, কিন্তু সারাদিন করলে রাইতেও করিস, বাড়িতে আসার দরকার নাই।’
জি আচ্ছা…
পাঠ্যবইয়ের আড়ালে মাসুদ রানা। ‘শোন আমিও দস্যু বনহুর পড়তাম তোর মতো। কিন্তু চোরের মতো পড়স কেন? মাসুদ রানা পড়তে সাহস লাগে, বুকের পাটা লাগে। চুরি কইরা পড়তে হইলে মাসুদ রানা পড়িস না।’
জি আচ্ছা…
‘সিগারেটটা জ্বালায়ে আন’। অতঃপর চুলার আগুনে সিগারেটের মুখাগ্নি। ‘তুই তো বড় হইতে শিখলিনা। মেট্রিক পাশ করছস, এখনো সিগারেট ধরাস গ্যাসের চুলা দিয়া?’ ‘জি আব্বা মানে, আপনি যদি কিছু মনে করেন?’ ‘বড় হইছস, সিগারেট তো খাবিই। শুধু ঘাড়ের উপর ধোঁওয়া ছাড়িস না।’
জি আচ্ছা…
‘আচ্ছা, এটা তুই কি করলি? পুরা এক বছরে একটাও ক্লাশ করস নাই কলেজে? ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল যে হইয়া গেছে তা জানস?’ ‘না, কিন্তু আপনে জানলেন কেমনে?’ ‘ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল নিজে চিঠি পাঠাইছে আমার কাছে। তুই আদৌ ঐ কলেজে পড়স কি না তা জানতে চাইছে। আমি যাইতে পারুম না। নিজের কীর্তি নিজেই সামলাইতে শিখ।’
জি আচ্ছা…
পত্রিকায় প্রথম লেখা ছাপা হওয়া… বিশাল শরীর নিয়া জাবড়ায়া ধরা… পিঠ চাপড়া… ‘হিইবো, তোরে দিয়া হইবো’
চার ভাই মিলে সারারাত টুয়েন্টি নাইন খেলা। আনাড়ি আমি, সর্বছোটো আমি। মন্ত্রণাদাতা হিসেবে বাবার সদা সর্বদা সতর্ক চোখ। আমার যেন ভুল চাল না হয়ে যায়। আর মা’কে বলা ‘পোলাপানগুলা সারারাইত খেলবে, আজকা একটা বৃহষ্পতিবার রাইত, একটু গরুর মাংশ হইলে ভালো হইতো না? অন্তত একটু মুড়ি চানাচুর মাখায়া দেও…।’
নাট্যকার আমি, বিটিভিতে পয়লা নাটক সম্প্রচার। ‘এটা কিছু হইছে? আরো অনেক ভালো করতে হইবো’
জি আচ্ছা…
হসপিটালে আব্বা, আমি পল্টনে কাজে ব্যস্ত। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। ’তুই আইসা কী করবি? আমার জন্য ডাক্তারই যথেষ্ট। কাজ ফালায়া আসনের দরকার নাই।’
আরো একবার হসপিটালে। সেজভাই টানা দুদিন সার্ভিস দিলো। একটা কয়েক ঘন্টার ছোট্ট ব্রেক দরকার। আমি হাজির। ‘তুই আসছস? লাগবো না, তুই থাকলে উল্টা আমারই টেনশন হইবো। যে তোর কোনো অসুবিধা হইতেছে কি না…! যা অফিস যা, কাজ কর।’
নাটক ছাড়া জীবনে আর কিছু করবো না। বড়জোড় লেখালেখিটা করতে পারি। এই হেতু উচ্চশিক্ষাহীন থাকার কঠোর সিদ্ধান্ত। নানাদিকে নানামুখি প্রতিবাদ। কিন্তু আব্বার এক কথা ‘যদি তার সিদ্ধান্ত ভুল হয়, দায় তো সেই বহন করবো তাই না?’
সারাজীবনই আমি পিছুটানহীন মানুষ হতে চেয়েছি। যা ইচ্ছা জীবন যাপন করতে চেয়েছি। ইশকুল বেলাতেই ঘরছাড়া হয়েছি। বাঁধনছাড়া হওয়ার উছিলায় ফুটপাথে রাত কাটিয়েছি। আমার এই যা তা জীবন নিয়েও আব্বার কোনো আপত্তি নাই। শুধু বলতেন ‘দেখ একটা জিনিস সবসময় মাথায় রাখবি। তোর জীবনটা তোরই যাপন করতে হইবো। অন্য কেউ যাপন কইরা দিয়া যাইবো না। তাই যা করবি, বুইঝ্যা করবি। ভুল হইলে দিশা হারাবি না। যে কাজ করে না, তারই কোনো ভুল হয় না। আমার কাছে ব্যর্থতা নিয়অ আসবি না। সাফল্য নিয়া আসবি। ব্যর্থতার বিরুদ্ধে একলা লড়াই করবি। কারো উপরে নির্ভর করবি না। নিজের শক্তিতে খাড়ায়া থাকবি পাহাড়ের লাহান।’
ব্যর্থতা হতাশা, চিন্তামগ্ন রাতজাগা, মাঝরাত্তিরে সকলে ঘুম। আমার দরোজায় কড়া নড়ে। ‘যদি মনে করিস যুদ্ধে একলা উৎরাইতে পারবি না, আমারে ডাকিস। তবু যুদ্ধ ছাড়বি না। হতাশ হইয়ো না যদি মুমিন হও।
আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৭ সালের ১ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত: http://www.sachalayatan.com/nazrul_islam/9063