সদ্যমৃত আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক প্রকাশ থেকে বিতর্কের সূত্রপাত। আমজাদ খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। সেই বিতর্কের সূত্র ধরেই তার মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে যতটুকু জানা গেলো তা এখানে একত্র করা হলো। খোঁজ নেওয়ার কাজ এখনো চলছে। এই পোস্টটি সময়ে সময়ে আপডেট করা হবে।
১.
শাফায়াত জামিল তাঁর স্মৃতিচারণমূলক বই “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” তে লিখেছেন “৩০ মার্চ তৃতীয় বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ন অ্যাডজুট্যান্ট সিরাজকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে একটা কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য পাঠানো হয়। তার সঙ্গে ১০/১২ জন সশস্ত্র প্রহরী ছিল। পাকিস্তানিরা পথে তাদেরকে বন্দি করে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সে রাতেই প্রায় সবাইকেই নির্মমভাবে হত্যা করে। দলটির মাত্র একজন সদস্য দৈবক্রমে বেঁচে যায়। পরে সে তৃতীয় বেঙ্গলের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পেরেছিল। উল্লেখ্য, তখন রংপুর ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেড মেজর পদে আসীন ছিলেন একজন বাঙ্গালী মেজর আমজাদ খান চৌধুরী। উল্লেখ, তিনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন এবং তারি নিয়জিত সেনা দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন পাহারার দায়িত্বে ছিল। আক্রমণকারীদের প্রতিরোধে এরা সেদিন ব্যর্থ হয়। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে তিনি পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।”
শাফায়াত জামিলের বইটি সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশ হয় ১৯৯৮ সালে। আমজাদ খান চৌধুরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বইয়ে উল্লেখিত তথ্যের কোনো প্রতিবাদ করেননি।
২.
ঢাকাটাইমস২৪ডটকমে প্রকাশিত প্রবীণ সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদের কলাম থেকে জানা যায় “রংপুর ক্যান্টনমেন্টে বিএম-২৩ ব্রিগেডের মেজর আমজাদ আহমদ চৌধুরী সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। রংপুর সেনানিবাসে অবস্থানকালে তিনি হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করার মতো কাজেও জড়িত ছিলেন। পঁচাত্তরের পর তিনি ব্যবসায় নামেন এবং মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন।“
শাফায়াত জামিলের তথ্যের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয় নতুন কিছু তথ্য, মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাটের অভিযোগ। যদিও এই তথ্যের সোর্স কী তা জানা যায় না। রংপুর সেনানিবাস প্রসঙ্গটা মিললেও নামে সামান্য অমিল দেখা যায় আমজাদ খান চৌধুরীর বদলে এখানে আমজাদ আহমেদ চৌধুরীর নাম পাওয়া যায়।
জাফর ওয়াজেদ এর ‘সেইসব বাঙালী পাকসেনা’ শিরোনামের কলামটি ঢাকাটাইমস২৪ডটকম নামের নিউজ পোর্টালে ছাপা হয় ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ তারিখে।
৩.
সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজের প্রধান এ এস এম শামছুল আরেফীন সম্পাদিত “মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ বইয়ের ৩৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ৯৫:১৯৭১ সরণীর অংশ হিসেবে একজন আমজাদ আহমেদ চৌধুরীর নাম পাওয়া যায়। যিনি ১৯৭১ সালে রংপুর সেনানিবাসে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এবং তারও পরবর্তীকালে ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। যিনি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান। প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যানই যে প্রাণ আরএফএল গ্রুপের আমজাদ খান চৌধুরী, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তাছাড়া শাফায়াত জামিল, জাফর ওয়াজেদ এবং শামছুল আরেফীনের তথ্যগুলো বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় ১৯৭১ সালে রংপুর সেনানিবাসে অন্য অনেকের সঙ্গে একজন বাঙালি মেজর ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত হন। সেক্ষেত্রে নামটা ‘আমজাদ খান চৌধুরী’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারন একই সঙ্গে ৭১ সালে রংপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে, তারও পরে ব্যবসায়ী হিসেবে আমজাদ আহমেদ চৌধুরী নামের কাউকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় শামছুল আরেফীনের বইতে আমজাদ খান চৌধুরীর নাম ভুলবশত আমজাদ আহমেদ চৌধুরী হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে জাফর ওয়াজেদ সেই নামটিই ব্যবহার করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইটি ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় সময় প্রকাশনী থেকে।
৪.
মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার আনোয়ার হোসেন ১৯৭১ সালে কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন রংপুর সেনানিবাসে। তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ’৭১ এর বীরগাঁথা’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন “২২ মার্চ ১৯৭১। কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে তৎকালীন ব্রিগেড মেজর আমজাদ খান চৌধুরীকে টেলিফোন করলাম। আমি তাকে বললাম, ‘স্যার, আপনি আমার চেয়ে পদমর্যাদায় অনেক সিনিয়র। আপনি মেজর আর আমি ক্যাপ্টেন। থার্ড বেঙ্গলের সৈনিকরা খুবই উত্তেজিত’। তিনি বললেন ‘কেন?’ আমি বললঅম ‘স্যার, আমি এখন আপনার সাথে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হিসেবে কথা বলছি না, আমি একজন বাঙালি হিসাবে আর একজন বাঙালির কাছ থেকে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি’। আমাকে তিনি বললেন, ‘বল, কি খবর?’ আমি বললাম, ‘স্যার, আমরা বিবিসির মাধ্যমে শুনেছি যে সেকেন্ড বেঙ্গলকে ডিজআর্ম করার জন্য এখানকার ব্রিগেড থেকে ব্রিগেড কমান্ডার গিয়েছিল এবং জয়দেবপুর রেলক্রসিংয়ে গোলাগুলি হয়েছে এবং এতে কিছু বাঙালি মারা গেছে। এটি কি সত্য? এ খবর শুনে আমার সৈনিকরা খুবই উত্তেজিত। আপনি আরো জানেন যে আমাদের যে কমান্ড ভয়েজ ছিল সেটি বন্ধ করা হয়েছে যেটা সামরিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে। সঠিক ঘটনাটা আমি জানতে চাই”। তিনি আমাকে বললেন, ‘আনোয়ার, আমি তো কিছুই জানি না’। তার কথা শুনে মনে হল তার ভেতরটা একেবারেই সাদা! তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। অথচ এটি ছিল ডাহা মিথ্যা কথা। তিনি আরো বললেন, ‘আমি জেনে তোমাকে জানাবো। আমি বললাম ‘ঠিক আছে’। এর ১৫ কি ২০ মিনিট পর আমি মেজর আমজাদের কাছ থেকে টেলিফোন পেলাম। তিনি বললেন, ‘আনোয়ার, ব্রিগেড কমান্ডার তোমাকে এবং তোমার সুবেদার মেজরকে (হারিছ মিয়া) এখনই ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করার জন্য বলেছে’। মেজর আমজাদের ফোন পাওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি সংকটময় মনে হতে লাগলো। সেই মুহূর্তে আমার যাওয়া উচিত হবে কি না তা বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমি গেলে যে জীবন্ত ফিরে আসব তার নিশ্চয়তা কি? সৈনিকেরা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাদেরকে বললাম, ‘ব্রিগেড কমান্ডার, আমাকে এবং সুবেদার মেজরকে কথা বলার জন্য ডেকেছেন। তোমরা বল, এখন আমার কি করণীয়?’ সৈনিকেরা একবাক্যে বলল, ‘স্যার, আপনি যাবেন না। কারণ আপনি গেলে ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। তারা জানে আমাদের থার্ড বেঙ্গলের রিয়ারে আপনি ছাড়া আর কোন অফিসার নেই। আপনাকে মেরে ফেললে থার্ড বেঙ্গল একেবারে অফিসার শূন্য হয়ে পড়বে’।
এই পর্যায়ে এসে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে রংপুর সেনানিবাসে ৭১ সালে আমজাদ খান চৌধুরী ব্রিগেড মেজর পদে কর্মরত ছিলেন।
আর এই স্মৃতিচারণ থেকে বাংলাদেশ প্রশ্নে আমজাদ খান চৌধুরীর ভূমিকাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে তৎকালীন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন বাঙালি সিনিয়র অফিসার হিসেবে যেখানে আমজাদ খান চৌধুরীর কাছে দিক নির্দেশনা চেয়েছিলেন, সেখানে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর দলকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। এবং তার ১৫/২০ মিনিট পরে তার ফোনালাপ থেকেই স্পষ্ট যে এর মধ্যে তিনি পাকি ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে আনোয়ার ও হারিছের নামে বিচার দিয়েছেন এবং ডেকে পাঠিয়েছেন হত্যা করার উদ্দেশ্যে!
এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আমজাদ খান চৌধুরীর সমপদমর্যাদার অন্য অফিসাররা যখন সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তিনি তার সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে খুন করার বা ধরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন!
৫.
আনোয়ার হোসেন এবং হারিছ মিয়ার উল্লেখ আমরা শাফায়াত জামিলের “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বইতেও পাই। সেখানে তিনি লিখেন “৩০ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের আবাসিক অবস্থানগুলোতে কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। সেখানকার একমাত্র বাঙালি অফিসার আনোয়ার হোসেন ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার। আনোয়ার ও সুবেদার মেজর হারিস মিয়ার নেতৃত্বে সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্রুত সংগঠিত হয়ে এই আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অমিত বিক্রমে রুখে দাঁড়ান”
এই বইতেই আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া যায়। “এ পর্যায়ের প্রচণ্ড সংঘর্ষে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আক্রমণকারী পাকসেনা দল এক সময় পিছিয়ে যায়। ভোর হয়ে এলে লড়াই স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু দিনের আলোয় রংপুর থেকে ট্যাঙ্ক আনিয়ে নতুন করে পাক হামলার আশঙ্কা দেখা দেয়। এদিকে আবার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তৃতীয় বেঙ্গলের ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী কামানগুলো সামরিক মহড়ার নামে সুকৌশলে ব্যাটালিয়ন থেকে সরিয়ে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় দিনের আলোয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছিল আত্মহত্যার শামিল। নিজেদের পক্ষে প্রচুর হতাহত এবং শত্রু পক্ষের ভারি অস্ত্র ও লোকবলের কারণে আনোয়ার তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদেরকে কৌশলগতভাবে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেয়”।
আমরা জানতে পারলাম আনোয়ার ও হারিছ মিয়ারা যাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সুবিধে করতে না পারে তাই ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী কামানগুলো দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ব্রিগেড মেজর হিসেবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে আমজাদ খান চৌধুরীর ভূমিকা কী ছিলো সেই প্রশ্নটার উত্তর হয়তো আর কোনোদিন জানা যাবে না।
৬.
মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউল্লাহ্ (বীর উত্তম) এর বই “মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ”-এ রংপুর সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর একটা চিত্র পাওয়া যায়। এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেঃ কর্নেল ফজল করিম। এই রেজিমেন্টের দু’টি কোম্পানী আলফা এবং ব্র্যাভোকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাঙালি অফিসার মেজর নিজামুদ্দিনের নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে ফেলে রাখা হয়। আরেকজন বাঙালি লেঃ মুখলেসের নেতৃত্বে একটি প্লাটুনকে গাইবান্ধায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভিএইচএফ স্টেশন পাহারা দেয়ার জন্য। সৈয়দপুরের চার্লি কোম্পানীর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন আশরাফ এবং ইউনিট কোয়ার্টার মাস্টার আনোয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্ল্যান গুছিয়ে আনে। ঘোড়াঘাটে মেজর নিজামের অনুগত সৈনিকরা ২৩ তম ফিল্ড রেজিমেন্টের দু’টি গোলন্দাজ ইউনিট উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। লেঃ রফিক সরকার আর লেঃ মোখলেসের নেতৃত্বে দু’টি প্লাটুন নিয়ে হামলার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু মোখলেসের ইউনিট পৌঁছতে দেরি করলে রফিক সরকার একাই আক্রমণ করে এবং ধরা পড়ে। তাঁকে পাকিস্তানীরা হত্যা করে।
ব্যাটালিয়ন সদর দফতরের এডজুটেন্ট লেঃ সিরাজুল ইসলামকে ঘোড়াঘাটে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পথে রংপুর ব্রিগেড সদর দফতরে যাত্রাবিরতি করার আদেশ দেওয়া হয়। সেখানেই সিরাজুল ইসলাম ও তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে কথা শাফায়াত জামিল তাঁর বইতে লিখেছেন।
২৬তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এর একটি কোম্পানী ৩য় ইস্ট বেঙ্গলকে আক্রমণ করে। আনোয়ার ও হারিছ মিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। এক পর্যায়ে পরিবারকে রেখেই তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরে যায়, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ওদিকে ক্যাপ্টেন আশরাফ রংপুর-বগুড়া সড়কে অবস্থান নেয়। আর মেজর নিজাম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করলে এবং পালিয়ে পাকিস্তান পক্ষে যোগ দিতে চাইলে সাধারণ বাঙালি সৈনিকেরাই তাকে হত্যা করে।
এই বর্ণনায় আমজাদ খান চৌধুরীকে আমরা পাই না। অর্থাৎ দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সাধারণ সৈনিকরাও যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছে, বিদ্রোহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে তখন মেজর পদকর্তার আমজাদ খান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয়, বিপক্ষে সক্রিয়। যুদ্ধকালে সেনানিবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় একজন ব্রিগেড মেজর নিরপেক্ষ বা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না। তাকে যে কোনো একটি পক্ষ বেছে নিতেই হয়। আমজাদ খান চৌধুরী যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো না তা স্পষ্ট। তাহলে কোন পক্ষে ছিলো?
রংপুর সেনানিবাসের বাঙালি অফিসারদেরকে দূর দূরান্তে পাঠিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখার পরিকল্পনায় আমজাদ খান চৌধুরীর হাত নেই তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আনোয়ার হোসেন ও হারিছদের উপর আক্রমণের পরিকল্পনাতেও তার হাত থাকার সম্ভাবনা বাতিল করে দেওয়া যায় না, যেমনি যায়না সিরাজুল ইসলামের বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনার পেছনে আমজাদ খান চৌধুরীর ভূমিকার সম্ভাবনা। কারন তখন তিনি ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, দায়িত্ব এড়াতে পারেন না কোনোভাবেই।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অফিসার সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ার, হারিছদের যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করার পরিকল্পনা করছে আমজাদ খান চৌধুরী সেখানে নিরাপদ। কিন্তু কর্ণেল শাফায়াত জামিলের ভাষ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বাঙালি অফিসার নিধন পরিকল্পনায় আমজাদ খান চৌধুরীরও হয়তো ভূমিকা ছিলো। আর ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয় আনোয়ার হোসেনের সাক্ষে।
এর পর থেকে আমজাদ খান চৌধুরীর আর কোনো নিশ্চিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। যদি মার্চের পরে আমজাদ খান চৌধুরীকে পাকিস্তানে বদলী বা বন্দী করা হয়ও, তাহলেও রংপুর সেনানিবাসে বাঙালি অফিসার নিধন পরিকল্পনায় তার অবস্থান অনুমান করতে কষ্ট হয় না। তাকে কেন হত্যার চেষ্টা করা হয়নি?
৬.
এই বিষয়ে এক ফেসবুক বিতর্কে নাজমুল আলম জানান “হ্যাঁ এটা ঠিক যে ৭১ এর মার্চে তিনি ব্রিগেড মেজর হিসেবে রংপুর ব্রিগেডে কর্মরত ছিলেন। মার্চ মাসেই তাকে (under custody) শিয়ালকোটে একটি বেলুচ রেজিমেন্টের ইউনিটে কম্পানি কমান্ডার হিসেবে বদলি করা হয়। আমি নিজে তখন শিয়ালকোটে ক্যাপ্টেন পদে অন্য একটি বেলুচ ইউনিটে কর্মরত ছিলাম”।
নাজমুল আলম-এর এই ভাষ্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনাসাপেক্ষ। কিন্তু তার ভাষ্য মেনে নিলে এটা স্পষ্ট হয় যে যুদ্ধ শুরু হলে আমজাদ খান চৌধুরী পাকিস্তান চলে যান এবং শিয়ালকোটে বেলুচ রেজিমেন্টের ইউনিটে কম্পানি কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন। আর এই অসমর্থিত ভাষ্য আমলে না নিলেও এটা স্পষ্ট যে আমজাদ খান চৌধুরী যুদ্ধের শুরুর দিকেই পাকিস্তানে চলে যান। যখন তার পদমর্যাদার অফিসাররা যুদ্ধ করছেন, এমনকি পাকিস্তান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন, তখন আমজাদ খান চৌধুরী পাকিস্তানের আনুগত্য মেনে নিয়ে পাকি সেনাবাহিনীতেই রয়ে যান। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
উল্লেখ্য আমজাদ খান চৌধুরীকে বন্দী করা হয়েছিলো এরকম কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানে তিনি বন্দী ছিলেন এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। ৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশে কর্মরত আর কোনো সেনা কর্মকর্তা কি যুদ্ধ অথবা মৃত্যু এড়িয়ে, বন্দী না হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছিলেন? আর কোনো সৌভাগ্যবান কি আছে এরকম?
৭.
আত্মসমর্পনকারী ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সেনার কোনো তালিকা এখনো পাওয়া যায়নি, তালিকা করা হয়েছিলো কি না সেটাই জানা যায়নি। সম্ভবত তালিকা করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে দুইশজন গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা, যারা যুদ্ধাপরাধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো, তাদের একটি তালিকা করা হয়েছিলো। আমজাদ খান চৌধুরীর নাম সেই তালিকায় অবশ্যই থাকার কোনো কারন নেই। কারন এই তালিকা করা হয়েছিলো শুধু পাকিস্তানী গুরুত্বপূর্ণ সেনা অফিসারদের নিয়ে, যাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের ভার পাকিস্তান সরকার নিয়েছিলো।
মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ যে ১৫৯৭ জন পাকি অফিসারের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানেও আমজাদ খানের নাম নেই। কারন এই তালিকাও শুধু পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের নিয়ে।
এখন সময় হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত অফিসারদের মধ্যে যেসব বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে বিরোধীতা করেছিলো তাদের তালিকা করার। সেই তালিকায় নিশ্চিতভাবেই আমজাদ খান চৌধুরীর নাম থাকবে।
৮.
আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুর পর হলেও এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে নতুন করে। এই আলোচনা শুরু হওয়াটা জরুরী। এর সূত্র ধরে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত অফিসারদের তালিকা ধরে ধরে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, কারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তা চিহ্নিত করাটা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। কারা মুক্তিযোদ্ধা, কারা যুদ্ধাপরাধী, কারা কোলাবোরেটর তা চিহ্নিত করাটা জরুরী।
৭৩-৭৪ সালে পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের সেনাবাহিনীতে যোগদান, পদাবনতি, সেনাবাহিনীর ভেতরকার রাজনীতি ইত্যাদির সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবেই যে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা, বঙ্গবন্ধু হত্যা, হাজারে হাজারে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ড তা না মেনে উপায় নেই। মনে রাখতে হবে শাফায়াত জামিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেও আমজাদ খান চৌধুরীর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
৯.
আমজাদ খান চৌধুরীর জীবনী থেকে ১৯৫৬ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যকার এই ২৫ বছর সময়কাল সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। হয়তো সচেতনভাবেই। অথচ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল পদের কর্মকর্তার জন্য এই সময়কালটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ৭১ পরবর্তী সময়ে। আমজাদ খান চৌধুরী নিজেই তার জীবনের এই সময়কালটা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক? কেন? ধরে নেওয়া যায় এই সময়কালে এমন কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত আছে, যা তিনি এবং তার স্বজনেরা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। এমনকি এই সময়কাল নিয়ে সবধরনের বিতর্কেও তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন সবসময়।
কিন্তু অন্ধ হলেই যেমন প্রলয় বন্ধ হয়ে যায় না। আমজাদ খান চৌধুরীর অতীতও অপ্রকাশ্য থাকবে না ধারনা করা যায়। মাত্র শুরু হলো, নিশ্চয়ই একদিন তার এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত উন্মোচিত হবে। তবে যতটুকু জানা গেছে তাতে তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকাই স্পষ্ট, সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।