একটি পতাকার জন্ম

একটি পতাকার জন্ম

১৯৬৬ সালের ৭ জুন তারিখে ৬ দফা আন্দোলনে তেজগাঁওয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শ্রমিক লীগের কর্মী মনু মিয়া। এর পর থেকে ৭ জুনকে ‘৬ দফা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

১৯৭০ সালে ৬ দফা দিবসে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভিবাদন দেওয়ার কর্মসূচী নেওয়া হয়। কুচকাওয়াজ ও সামরিক অভিবাদন দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে আ. স. ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। সিদ্ধান্ত হয় একটি ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ বানানো হবে, যা শেখ মুজিব এই বাহিনীর হাতে তুলে দেবেন।

আগেরদিন ৬ জুন সন্ধ্যায় ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর ঘরে কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনি, শাজাহান সিরাজ ও আ স ম আব্দুর রব বসেন পতাকা বিষয়ক আলোচনায়। কাজী আরেফ বলেন পতাকাটা এমনভাবে বানাতে হবে যাতে এটাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়। মার্শাল মনি আর আব্দুর রব প্রস্তাব করেন বটলগ্রিন জমিনের। শাজাহান সিরাজ বলেন লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকা দরকার। সে অনুযায়ী কাজী আরেফ পতাকার একটা নকশা তৈরি করেন। বটলগ্রিন জমিনের ওপর মাঝখানে গোলাকার লাল সূর্য। নকশা সবার পছন্দ হয়। সিরাজুল আলম খানের অনুমোদন পাওয়া যায়।

তখন পাকিস্তান সরকার বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, (তৎকালীন) পূর্ব পাকিস্তান ও আরাকানকে একত্র করে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল’ নামের এক কল্পিত রাষ্ট্রের প্রচার চালাচ্ছিলো। ম্যাপও প্রচার হচ্ছিলো। এটা করা হচ্ছিলো মূলত ভারতকে বিভ্রান্ত করতে। তাই সেই অপপ্রচার থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বলতে ঠিক কতটুকু আমরা চাই তা বোঝাতে বাংলাদেশের একটি ম্যাপ পতাকায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

কামরুল আলম খান খসরুকে পাঠানো হয় পতাকা তৈরি করতে। খসরু নিউমার্কেটের অ্যাপোলো নামের এক দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে উল্টোপাশে বলাকা সিনেমা হল বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ‘পাক ফ্যাশন’ নামের এক দর্জির দোকানে যায়। সেই দোকানের দর্জি ছিলেন আব্দুল খালেক আর তার সহযোগি মোহাম্মদ নাসিরউল্লাহ্, দুজনেই বিহারী। তারা নকশামতো পতাকাটি সেলাই করে দেয়। সেই পতাকা খসরু নিয়ে আসেন ইকবাল হলে।

কিন্তু পতাকার ওপর বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকবে কে? কুমিল্লার ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে তখন ঢাকাতেই ছিলেন। তাঁকে ডেকে আনা হলো। তিনি ভালো আঁকতে পারতেন। কিন্তু শিবনারায়ণ দাশ জানালেন ম্যাপ তিনি আঁকতে পারবেন না, শুধু মানচিত্রের ওপর রঙ করতে পারবেন। তখন হাসানুল হক ইনু আর সালাউদ্দীন ইউসুফ গেলেন বুয়েটে। আহসানউল্লাহ হলের ৪০৮ নম্বর ঘরে থাকতেন এনামুল হক। তার কাছ থেকে মানচিত্রের বই অ্যাটলাস নিয়ে আসা হলো। সেই অ্যাটলাস থেকে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো বাংলাদেশের মানচিত্র।

এর মধ্যে সোনালী রঙ কিনে আনা হয়েছে। শিব নারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে পতাকার লাল বৃত্তের মাঝখানে আঁকলেন বাংলাদেশের মানচিত্র।

পুরো ব্যাপারটি করা হয় খুব গোপনে। মোট ২২ জন ছাত্র এতে যুক্ত থাকেন। কাজী আরেফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, কামরুল আলম খান খসরু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, সালাউদ্দিন ইউসুফ, স্বপন কুমার চৌধুরী, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, রফিকুল ইসলাম, আবদুল্লাহ সানি, এনামুল হক, শিব নারায়ণ দাশ, মনিরুল হক, নজরুল ইসলাম, শেখ শহিদুল ইসলাম, চিশতী শাহ হেলালুর রহমান, মইনুল ইসলাম চৌধুরী আজাদ, গোলাম ফারুক, জিনাত আলী, ও শেখ মোহাম্মদ জাহিদ। এছাড়া দুই দর্জি আব্দুল খালেক ও মোহাম্মদ নাসিরউল্লাহ্ এবং বুয়েটের ছাত্র এনামুল হক ঘটনাচক্রে যুক্ত হয়েছিলেন এই পতাকা নির্মাণের কাজে।

পরদিন সকালে পল্টন ময়দানে কুচকাওয়াজে এই পতাকাটিই শেখ মুজিব তুলে দেন আ স ম আব্দুর রবের হাতে।

পরের বছর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ রেডিও ঘোষণায় যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন, তখন সারা বাংলাদেশ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলো। ইকবাল হলে (জহুরুল হক হল) বসলো ছাত্রলীগের মিটিং। ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ জাহিদ। তিনি রাত সাড়ে ৯টার দিকে ইকবাল হলের মিটিং থেকে বের হয়ে গেলেন ছাত্রলীগের কার্যালয় মতিঝিলের বলাকা বিল্ডিংয়ে। সেখানে ছাত্রলীগ নেতা ও দৈনিক বাংলার ক্রীড়া প্রতিবেদক মাসুদ আহমেদ রুমি জাহিদের হাতে খবরের কাগজে মোড়ানো একটি প্যাকেট দিলেন। রাতে জাহিদ এই পতাকাটি তুলে দেন মহিব উল ইসলাম ইদুকে। পরদিন সকাল দশটায় মিটিং, তার আগেই পতাকা নিয়ে ইদুকে হাজির থাকতে বলা হলো।

পরদিন ২ মার্চ ১৯৭১। সকাল ৮টায় গুলবাগ রেললাইনে সমবেত হতে থাকে ছাত্ররা, ইদু পতাকা নিয়ে আসে। একটা দোকানের ঝাপ থেকে বাঁশ খুলে পতাকাটাকে সেই বাঁশে বেঁধে নেয় জাহিদ। তারপর পতাকা নিয়ে মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে। কণ্ঠে স্লোগান ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’।

মিছিল এগিয়ে চলে রামপুরা হয়ে মৌচাক, সিদ্ধেশ্বরী আর বেইলি রোড পেরিয়ে। মিছিল যখন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধার সামনে, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু সৈনিক মিছিলের সামনে আসে। কিন্তু মিছিলে ততোক্ষণে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হয়ে গেছে। সেনারা পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে, রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভেতর দিয়ে মিছিলটি পৌঁছায় কলাভবন চত্বরের আমতলায়। সেখানে তখন লাখ লাখ মানুষ, মিছিলে উত্তাল। গাড়ি বারান্দার ছাদকে মঞ্চ বানিয়ে ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব সভা পরিচালনা করছেন। তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকীরাও আছেন। জাহিদ ইদুদের মিছিলটি এগিয়ে যায় সেদিকে। ইদু’র হাতে পতাকা। জাহিদ পতাকাটি নিয়ে তুলে দেন রবের হাতে। রব পতাকাটি তুলে ধরেন। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় পতাকাকে।

পরদিন ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সঙ্গে এই পতাকা উত্তোলন করেন শাজাহান সিরাজ। উল্লেখ্য তখনো এই পতাকা এবং গান জাতীয় মর্যাদা পায়নি। ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবসে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আর গাড়িতে এই পতাকা তুলে দেওয়া হয়।

১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে আমবাগানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা হিসেবে এই পতাকাটিই উত্তোলন করা হয়। পরদিন কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে উত্তোলন করা হয় এই পতাকা।

৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পটুয়া কামরুল হাসানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও ব্যাখ্যাসহ একটি প্রতিবেদন দিতে। কামরুল হাসান তখন মানচিত্রহীন পতাকার মাপ ইত্যাদি ঠিকঠাক করে দিলে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করে।

পতাকায় শিব নারায়ণ দাশের অবদান কেবল ঐ মানচিত্রটুকু ছাপ দিয়ে আঁকাই। পতাকা থেকে সেই মানচিত্রই ফেলে দিলে শিব নারায়ণ দাশের অবদান বলতে আর কিছু রইলো না। তবু কোনো এক অজ্ঞাত কারনে সবাই তাঁকেই জাতীয় পতাকার ডিজাইনার বলেন।

যদিও পতাকার এই ডিজাইনের আরেকটি ভাষ্য আছে। ১৯৭০ সালের ৮ জানুয়ারিতে সর্বহারা পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বেশ কয়েকটি জায়গায় একটি পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়ে সবুজ জমিনের বুকে লাল বৃত্তের একটি পতাকা। সেই লাল বৃত্তের মধ্যে তিনটি জ্বলজ্বলে মশাল। সিরাজ শিকদারের তখনকার প্রধান সহযোগি সাইফুল্লাহ আজমী পতাকার এই নকশা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ফজলুল হক রানা। উল্লেখ্য সাইফুল্লাহ আজমী ছিলেন অবাঙালি, বিহারী। আর সর্বহারা পার্টির একাংশের (সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদ) সাবেক সভাপতি রইসুদ্দিন আরিফ জানিয়েছেন বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে সবখানে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের বহিপ্রকাশ, তাই পতাকাতে তিনটি মশাল প্রতিনিধিত্ব করছিলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতীগত সংখ্যালঘু ও ভাষাগত সংখ্যালঘু।

যদিও এই পতাকার কোনো ছবি বা কোনো রূপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু সর্বহারা পার্টি ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারেই এই পতাকার বিবরণ পাওয়া যায়।

[০২ মার্চ ২০২০ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus