করোনাক্রান্তি ২

করোনাক্রান্তি ২

১.
পাঁচদিন আগে যিনি মাস্ক, হ্যান্ডগ্লভস পরে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে গাড়ি ভর্তি করে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন… ভেবেছিলেন করোনাক্রান্তিকাল শেষ হবার আগে কোনোভাবেই বাড়ি থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা, জানালা দিয়ে উঁকি পর্যন্ত দেবেন না… আজ তার উসখুশ মন। বাজারের বেশিরভাগটাই সদ্ব্যবহার করা হয়নি, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের স্তুপ পরে আছে গৃহকোনে, টয়লেট টিস্যুগুলোও সেভাবেই। নেটফ্লিক্স দেখতে দেখতে, ফেসবুকিং করতে করতে আজ তিনি ক্লান্ত। পরিবারকে অনেক সময় দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু আজীবন ব্যস্ততায় শেখাই হয়নি পরিবারকে সময় দেওয়ার কৌশল, অথবা পরিবারের সঙ্গে এতোটা সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া যে একটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার, সে বোধটুকুই তৈরি হয়নি। ফলে একটানা পাঁচদিইইইইন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েই বোরড! প্রিয়জন একটা ভালো কথা বললেও ঘ্যানঘ্যানে মনে হয়।

মনে হয় কতোদিন রাস্তায় বের হওয়া হয়নি! রাস্তার যে ট্র্যাফিক জ্যামে বিরক্ত হয়ে সারাক্ষণ ’ফাক ফাক’ গালি দিতেন, এখন সেই জ্যাম দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে প্রাণ। ক্রমাগত বেজে চলা হর্নের শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে ‘এই বালের দেশে আর থাকুমই না’ বলতেন, অথচ এখন মনে হচ্ছে ‘ইশ, একটু যদি কেউ হর্ন বাজাতো!’ অস্থির একটা জীবনে দীর্ঘ অভ্যস্থতার পর হঠাৎ করে এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হাঁপিয়ে উঠছেন!
কী জানি কিসেরও লাগি প্রাণও করে হায় হায়…

মনে হলো, ’কী আর হবে? কই ইতালী স্পেন আমেরিকার মতো তো খারাপ দশা তো আমাদের হয়নি এখনো। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? তারচেয়ে এই ফাঁকা রাস্তায় একটা লঙ ড্রাইভ মেরে দিলে কেমন হয়?’

গাড়ির ইঞ্জিনটা অনেকদিন পর চালু হলো…

২.
বৃদ্ধ বয়সে কানে ধরে উঠবস করতে কোনো কষ্ট হয়নি জমিরুদ্দিনের, মান অপমান বোধ তো বহুকাল আগেই ত্যাগ করেছেন, শুধু কষ্ট হয়েছিলো ’ছাওয়াডা খাইবো কী?’ চিন্তায়।

গ্যারেজে রিকশাটা জমা দিয়ে এক চিলতে ঘরে জড়ো হয়েছিলেন পরিবারের এন্দা গেন্দা মেন্দা পেন্দা সকলে। যতটুকু চাল ছিলো, ফুরিয়ে গেছে। ডাল তবু পানি আর লবন দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। আর কিছু নেই। ঘরে টিভি নেই, স্মার্টফোনও নেই। তবু বিনোদনের কোনো অভাবও নেই। পরিবারের সবাই মিলে সেই এক চিলতে ঘরেই নিজ পরিবারের সঙ্গে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনকি বছরও কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

অসুবিধা শুধু একটাই… খাবার নেই। ঘর থেকে বের হওয়া দরকার।
পুলিশে ছুঁলে কানে ধরা, করোনায় ছুঁলে হয়তো মরা, কিন্তু ক্ষুধায় তো খাড়ামরা…

তাই বৃদ্ধ জমিরুদ্দিন পাঁচদিন পর ক্ষুধা পেটে আবার রিকশার প্যাডেলে পা রাখলেন। ভেবেছিলেন যাত্রী পাবেন না, সাহেবদের তো আর তার মতো পেটের দায় নেই।

কিন্তু জমিরুদ্দিনের কপাল ভালো, রাস্তায় যাত্রীর অভাব নেই। একজন দুজন করে লোকজন বের হতে শুরু করেছে! আহ্, বাঁচা গেলো…

৩.
দু’সপ্তাহ তো দূর, পাঁচদিনের মধ্যেই আবার আমরা সরগরম করে তুলতে শুরু করছি দেশটাকে। ভয় দীর্ঘজীবী হয়নি।

যদিও এই ’সাহস’কে বীরত্ব বলা যাচ্ছে না, আত্মঘাতী বলাই ভালো।

ইতালী, স্পেন, নিউইয়র্কেও বিপদের প্রথম দিনগুলো এরকমই ছিলো। তারাও ঠিক আমাদের মতোই ভেবেছিলো ‘আরে ধুর, কিসসু হবে না’। তারপর ধুম করে যখন করোনা মহামারী হয়ে গেলো… তখন সত্যিকার অর্থে আর কিছু করার ছিলো না মৃত্যুবরণ করা ছাড়া।

পাঁচ দিনেই যদি অধৈর্য্য হয়ে যাই, তাহলে আমাদের অবস্থাও তাদের মতোই হতে পারে।

৪.
তাই, ঘরে থাকুন। কষ্ট করে হলেও ঘরে থাকুন। দয়া করে হলেও ঘরে থাকুন। ধৈর্য্য ধরে হলেও ঘরে থাকুন। পরিবারের লোকজনের আদর সোহাগ বিরক্ত লাগলে ঝগড়া করে হলেও ঘরে থাকুন। এখন অনেক স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠান ঘরে ঘরে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, সেগুলো খেয়ে ঘরে থাকুন। প্রয়োজনে একবেলা খেয়ে ঘরে থাকুন। যেভাবেই হোক, ঘরে থাকুন।

মাত্র পার হয়েছে ৫ দিন, আরো অন্তত ১০ দিন ঘরে ঘরে থাকতে হবে। মিনিমাম…

’একদিন তো মরেই যাবো, দুইদিন আগে মরলে কী অসুবিধা’ ভেবে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে বীরত্ব দেখিয়ে হলেও ঘর থেকে বের হবেন না দয়া করে। কারন আপনি করোনাক্রান্ত হলে শুধু যে আপনারই বিপদ তা না, আপনার মাধ্যমে আপনার পরিবার, পার্শ্ববর্তী পরিবার এবং আরো অনেকেই আক্রান্ত হতে পারে। আপনি একাই হতে পারেন শত শত হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর কারণ।

নিজেকে খুনি ভাবতে কি গর্ববোধ হয় আপনার?

করোনা যতোটা না প্রাণঘাতী, তারচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র এই অভিনব ছোঁয়াচেপনার কারনেই।

আপনার ইচ্ছে হলে নিজেকে অন্যভাবে মরেন, যা খুশি তা করেন, কিন্তু হেলায় ফেলায় অবহেলায় আপনার আশেপাশের মানুষদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার কোনো অধিকার আপনার নাই। এটা কোনো ফাইজলামির ব্যাপার না।

অতএব… ঘরে থাকুন। এটা কোনো অনুরোধ না

[৩১ মার্চ ২০২০ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus