আমাদের বাঁচিয়ে রাখা এ সময়ের সবকিছুই যেন বড় উচ্চকিত, গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। সশব্দ জনজীবনের নির্যাস নিয়ে লেখা অনেক চড়া তারের গল্পের ভিড়ে তারেক নূরুল হাসানের গল্পগুলি যেন নিঝুম দুপুরে পুকুরপাড়ে চালতা খসে পড়ার মতো- অতর্কিত মৃদু বোলে যে ইঙ্গিত দেয় ঘটনার, চরিত্রের। রোদেলা দিনে কিশোরের বাইসাইকেলের মতো সচেতন কিন্তু ছায়াময় সেই গল্পের ভাষার চলন, পথের বুকে যা স্পষ্ট একটি রেখা পেছনে ফেলে যায়, যার ঘন্টার রিনরিনে স্মৃতি ভেসে থাকে বাতাসে। দৃষ্টি আকর্ষণী উন্মত্ত চিৎকার নেই, আপন ঢোল ভেবে যথেচ্ছ বাদনবিভ্রাট নেই, তাঁর গল্পগুলি যেন সন্ধ্যায় পাঠকের দোরে কোমল করাঘাত করে ডাকে, ‘বাড়ি আছো?
[কাঠের সেনাপতির প্রথম প্রচ্ছদ]
তারেক নূরুল হাসানের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কাঠের সেনাপতি’। প্রকাশ হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০১০ এ। বইটি পড়তে গেলে প্রথমেই পড়তে হবে উপরের অংশটুকু। মাহবুব আজাদের লেখা ছোট্ট এই কটি কথার রোদেই ভেসে ওঠে তারেকের গল্পের গোটা চরাচর। তারেকের গল্প সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার থাকে না।
গ্রন্থজগতে নতুন হলেও গল্প লেখার চর্চা বহুদিনের। অন্তর্জালের মহা উচ্চকিত জগতে, যেখানে লাল মানে তীব্র লালটাই বলতে হয়, যেখানে মিনমিন করে বলা কথা হারিয়ে যায় কোলাহলে… সেই অসম্ভব এক জগতে আপাত নিরীহ গল্পগুলো নিয়ে তারেক রাজত্ব করে চলেন। রাজত্ব করে চলেন কনফুসিয়াস নামে। মলাটবন্দী জবাবহীনতা নয়, তীক্ষ্ম সমালোচনা আর জবাবদিহিতার জগতে তারেক নূরুল হাসান কনফুসিয়াস টিকে থাকেন, বুঝিয়ে দেন চিৎকার করতে হয় না, যদি চিন্তার জোর থাকে।
সমান্তরাল, বউ, কাঠের সেনাপতি, ইঁদুর, নিমন্ত্রণ আর শব্দশিল্পী- এই ছটি গল্প নিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠার এই বই। প্রকাশ করেছে শস্যপর্ব।
[কাঠের সেনাপতির বর্তমান প্রচ্ছদ]
পিতা আর পুত্রের গল্প সমান্তরাল। পিতার মৃত্যুর পর খবর পেয়ে দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরেছে পুত্র। আকাশ কেঁদে চলেছে। আগুন পুড়ছে সিগারেট, একটি সিগারেট জ্বলার সময়টুকুতে পাঠক একে একে জানতে থাকেন পিতৃহারা এক যুবকের অন্তর্জালা। সে অন্তর্জালা পিতার মৃত্যুশোকের নয়, পিতার প্রতি এক ধরণের ঘৃণার বিস্তার ঘটে চলে। সেই জ্বালা নিজের অন্তরে ধারণ করেও মেটে না, কবরেও ছড়িয়ে দিতে চায়।
শুরুর নিরীহ শব্দগুলো ভাবতেও দেয় না গল্পের শেষে কতটুকু চমক আছে। দীর্ঘ বাক্যগুলো একের পর এক রচে চলে সম্পর্কের জাল। মাকড়সার মতো। রিলে রেসের কাঠির মতো বাবা থেকে মা, মা থেকে আবার বাবা, সেখান থেকে প্রিয়তি… একে একে আসে চরিত্রগুলো। অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনার আবেশে ঘিরে পাকড়াও করে নিয়ে যায় গল্পের অন্তিমে…
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়েছি-আর খানিক পর পর হাত চোখের সামনে তুলে আঙুল দুটোকে দেখেছি। হঠাৎ খুব বেশি আপন মনে হচ্ছিল ঐ দুটোকে, এমনকি ভাত খাবার সময় যখন খাবার মুখে তুলছিলাম, বার বার মনে হচ্ছিল, এই দু'জন বেশি কষ্ট পাচ্ছে না তো!
অনুভূতির কী চমৎকার বর্ণনা।
দ্বিতীয় গল্প বউ। সাদামাটা অফিসের এক চাকুরে মনজুরের জগৎ এই গল্প জুড়ে। যে মনজুর সবকিছু বড্ড বেশি মনে রাখে। মনে ধরে রাখে শাহানাকে, ছোট্টবেলার টিফিনবক্সকে, আর শাহানার সঙ্গে ঠোঁট লাগিয়ে পর পর বাজিয়ে চলা সেই ময়ূরকণ্ঠী রঙের মাউথ অর্গানটাকে। মনের গহীনে ধরে রাখে শাহানার ছলোছলো দিঘীর মত ছায়াওলা চোখটিকে…
অথচ যে শাহানাকে মনজুর ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু মনে তার নিত্য আসা যাওয়া। সেই মনে নতুন করে রচিত হয় রুমার গল্প। কে এই রুমা?
এ এক চমক। কিন্তু চমকটা আরো পরে টের পেলে ভালো হতো। অনেকটা আগেই প্রকাশ হয়ে যায় বলে মনে হয়েছে আমার।
বরাবরের মতোই কাঠের সেনাপতিও প্রবল এক নিরীহ গল্প। এক ছুটির অলস বেলায় পিতা পুত্র বসেছে দাবা খেলতে। দর্শক মা, আর দর্শক দেয়ালে ঝোলানো এক হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালা। যার মোহনীয় ডাক শুনে লাখো মানুষ প্রাণের বিণিময়ে রক্ষা করেছিলো রাষ্ট্রের সম্মান আর স্বাধীনতা। হটিয়ে দিয়েছিলো হানাদার বাহিনীকে।
দাবা বোর্ডের ঘুটিগুলো নড়ে চড়ে ওঠে। সৈন্যরা দিক পরিবর্তন করে, হাতি ঘোড়া কিস্তি সব ঘিরে ধরে সেনাপতিকে।
ভেসে আসে অন্তিম চিৎকার, বাবা, তোমার রাজা বাঁচাও।
ধূলি ধূসরিত রাজা পড়ে থাকে মাটিতে। ঠিক সেই হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার মতো, বঙ্গবন্ধুর মতো… ১৫ আগষ্টের মতো…
অদ্ভূত বর্ণনা।
এর পরের গল্প ইঁদুর। একেবারে ভিন্ন স্বাদের গল্প। আগের গল্পগুলো খুব অতীতচারী ছিলো। গল্পটা এক জায়গায় দাড়িঁয়ে থেকে পাঠককে পাঠিয়ে দিতো অতীতে। ইঁদুর ব্যতিক্রম। শুরু থেকেই এক নিষ্ঠুর যুবকের ছবি আঁকতে থাকেন লেখক। মানুষ মেরে ফেলাটা যার কাছে ৫ দোকান ঘুরে ইঁদুর মারার কল কেনার চেয়ে সহজ।
মনে হয়েছে ইঁদুর বিদেশের পটভূমিতে লেখা। অন্য গল্পগুলো ছুয়েঁ আছে বাংলাদেশের মাটি। ইঁদুর ব্যতিক্রম। কেন? এই ভয়ঙ্কর মানসিক বিকৃত লোকটাকে বাংলাদেশের ভাবতে কষ্ট হয় বলে?
লাভ নেই, দেশ এখন অনেক এগিয়ে গেছে…
এর পরের গল্পটা সত্যিকার অর্থেই অদ্ভুত। অন্তত ভূত আছে। গল্পটার নাম নিমন্ত্রন। ভূতের গল্পগুলোকে অদ্ভূতুরে বানানোর জন্য জবরদস্ত একটা চেষ্টা চলে সবখানে। নানান তাণ্ডব করে ভয়টা যেন পাওয়াতেই হবে। কিন্তু তারেক যথারীতি ব্যতিক্রম। খুব স্বাভাবিক বর্ণনায় তিনি লিখে চলেন অশরীরী এক গল্প। পাঠককে নিমন্ত্রন জানিয়ে যান অলৌকিক এক জগতে।
শেষ গল্প শব্দশিল্পী। সবচেয়ে দীর্ঘ গল্পও। খুব সাদামাটাভাবে শুরু করে ধীরে ধীরে কঠিন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে গল্পটা। পাঠক একটুও টের পায় না, কোথায় যাচ্ছে সে। এখানেই তারেকের মুন্সিয়ানা। শব্দের পর শব্দ জুড়ে দিয়ে তারেক এঁকে চলেন দারুণ এক চিত্র। যার ক্যানভাসটা অনেক বিশাল।
এখানে আরেকটা কথা বলে ফেলি, ব্লগের খাতিরে বাংলা ভাষায় এখন ছোটগল্প বাড়ছে প্রচুর। একটা ব্লগেই একটা গল্প শেষ করে ফেলা যাচ্ছে, পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে তাৎক্ষণিক। এর প্রথম সুবিধা হলো প্রচুর লেখক গল্পকার তৈরি হচ্ছে। তবে কিছু অসুবিধাও থাকছে।
ব্লগ পড়া হচ্ছে খুব দ্রুত। দৌড়ের উপর মন্তব্য ঝেড়ে পরের ব্লগে যাত্রা। আগের ব্লগে হয়তো কারো প্রতি সমবেদনা জানাতে হলো, তো পরের ব্লগেই অন্যজনের চরম খুশির সংবাদ। এর মাঝখানে গল্পটা পড়ে ফেলে পাঠক। মন্তব্যগুলোও হয় সে মাপেই।
এই পাঠককে আকৃষ্ঠ করতে প্রয়োজন মোটা দাগের চমক। তাই ব্লগে অনেকেই গল্পের চেয়ে গল্পের শেষে মোটা দাগে একটা ‘ধাক্কা’ দিতেই বেশি উৎসাহী। ‘ধাক্কা'য় আপত্তি নেই, কিন্তু ধাক্কার আগে গল্পটা প্রয়োজন।
তারেক গল্পটাই প্রথমে লেখেন, তারপর ‘ধাক্কা’ দেন পাঠককে। তারেকের বর্ণনাগুলো খুব সুন্দর হয়। গল্পের জন্য না হলেও, এমনিতেই পড়তে ভালো লাগে। হয়তো কবি বলেই কাব্যময়তা থাকে। পড়তে পড়তে আবেশী এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে।
ধন্যবাদ তারেক নূরুল হাসানকে, চমৎকার কিছু গল্প পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।