কিশোর কুমার দাস, যেতে পারেন কিন্তু কেন যাবেন?

কিশোর কুমার দাস, যেতে পারেন কিন্তু কেন যাবেন?

‘বিদ্যানন্দ’ যখন ১ টাকায় খাবার দেয়, তখন তা সবার জন্য ১ টাকা মূল্যেই দেয়… হিন্দুদের জন্য ১ টাকা আর মুসলমানদের জন্য ২ টাকা হয়ে যায় না ব্যাপারটা। ‘ভাসমান’ বেদে, ‘ছোটলোক’ হরিজন, ‘পাইক্যা’ বিহারী, ‘অচ্ছুৎ বেশ্যা’, ‘সাপ ব্যাঙ খাওয়া’ আদিবাসী… সবাই বিদ্যানন্দের কাছে সমান… বিদ্যানন্দের কাছে এদের সবার একটাই পরিচয়… “মানুষ”।

স্বনামে, বেনামে, ছদ্মনামে, বিনা নামে যাঁরা ‘বিদ্যানন্দ’কে কোটি কোটি টাকা আর্থিক যোগান দেন, তাঁরাও “মানুষ”।

যে শত শত স্বেচ্ছাসেবী কোনোরকম খ্যাতি বা লোভ ছাড়া দিনরাত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরাও “মানুষ”।

আর বছরের পর বছর ধরে যারা ‘কিশোর কুমার দাস তো মালাউন, তার প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিলে ধর্ম যাবে, জাত যাবে রব তুলছে’, তারা “অমানুষ”।

ব্যাপারটা ঠিক এরকমই, সিম্পল। এর মধ্যে কোনো ‘যদি, কিন্তু’ নাই।

গত ৬ বছরে ‘বিদ্যানন্দ’ সাধারণ মানুষের যে আস্থা অর্জন করেছে, বাংলাদেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠানই বোধহয় ঐ আস্থাটুকু অর্জন করতে পারেনি। বিদ্যানন্দ যদি আজকে একটা পোস্ট দেয় ‘টাকা দেন জরুরী দরকার’। এক ঘন্টায় কোটি কোটি টাকা মানুষ বিনা প্রশ্নে পাঠায়ে দিবে।

‘বিদ্যানন্দ’র একটাই সমস্যা, তারা হিসাবের বেলায় স্বচ্ছ, দুই নম্বরি আর দূর্ণীতি করতে জানে না। ১০ জনের মধ্যে যদি ৯ জন চোর হয় আর ১ জন হয় ভালো মানুষ, তাহলে বাকি ৯ জনের খুব সমস্যা হয়। তখন নিয়ম হলো ঐ ১ ব্যাটাকে যেভাবেই হোক সরায়ে দিতে হয়।

আর বাংলাদেশে যখন কাউকে আপনি কোনোভাবেই হারাতে পারবেন না, কুপোকাত করতে পারবেন না, দাবায়ে রাখতে পারবেন না, তখন আপনার হাতে একমাত্র অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে ‘ধর্ম’। শত বছরের পুরনো হলেও এই একটা অস্ত্র এখনো খুব ধাঁড়ালো।

ছোটবেলা থেকেই নানারকম ‘অমানবিকতা’ সয়ে বড় হওয়া কিশোর কুমার দাস সম্ভবত এই কথা ভালোই জানেন, তাই তিনি কখনোই বিদ্যানন্দর গৌরব নিজের মাথায় নিয়ে ‘আমি কী হনুরে’ হতে চাননি। নিজেকে যথাসম্ভব আড়ালে রেখেছেন, এখনো রাখতেই চান। তাঁর যতটুকু প্রকাশ, সেটুকু সম্ভবত আমাদের মিডিয়ার জোরাজুরির প্রাবল্যে।

কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হয়নি। ধর্মের চাল চলছেই। তার প্রেক্ষিতে ‘বিদ্যানন্দ’ তাদের ফেইসবুক পেইজে আজ একটা পোস্ট ঝুলিয়ে জানিয়েছে যে ৯০ শতাংশ মুসলমানের স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ‘বিদ্যানন্দ’র গুরুদায়িত্ব থেকে সরে গেছেন ‘হিন্দু’ কিশোর কুমার দাস, এখন থেকে সাচ্চা মুসলমানদের দ্বারাই এটা পরিচালিত হবে।

‘বিদ্যানন্দ’ কোনোকালেই কোনো ব্যক্তিনামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তাদের পরিচালনা পর্ষদের নামও কোথাও নাই। শুধু উদ্যোক্তা বা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে এক জায়গায় ছোট করে কিশোর কুমার দাসের নাম আছে, ছবি নাই। যার উপস্থিতিরই প্রচার নাই, তার সরে যাওয়ার প্রচারটা কেন ফলাও করে করতে হলো?

অধম নজরুল কহে শুনো পূণ্যবান… এখানেই রাজনীতিটা রয়েছে লুকায়ে।

আপনি যখন একটা ভালো কাজ করতে চাইবেন, তখন কুচক্রীরা সেটা থামানোর জন্য এই কাজগুলো করবেই, এবং করতেই থাকবে। একবার রেগে গিয়ে যদি মাথা গরম করে ঝগড়া করতে যান, সেখানেই আপনার পরাজয় ঘটবে। ‘বিদ্যানন্দ’ সেই পথে যায়নি, এসব উটকো ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে সম্ভবত। ব্যাকফুটে যাওয়াও একটা ভালো কৌশল। বিদ্যানন্দ সম্ভবত ব্যাকফুটে খেলতে চেয়েছে। আর এজন্যই ব্যাপারটা ফলাও করে জানান দিতে হয়েছে।

কিশোর কুমার দাস-এর এই সিদ্ধান্তকে স্যালুট জানাই, আজাইরা ঝামেলা করার চেয়ে মানুষের উপকার করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী।

কিন্তু আমার আপত্তিটা আসলে ভিন্ন জায়গায়। এখানে একটা তীব্র রাজনীতি আছে। সেই ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। আর সেজন্যেই এতো সহজে ‘হেরে যাওয়া যাবে না’।

আজকে যারা ‘মালাউন’ কিশোর কুমার দাসের বিরোধীতা করছে, তারা দুদিন পর পর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পাল্টে দেওয়ার দাবী জানায় রবিঠাকুরের লেখা বলে। তারাই পহেলা বৈশাখ থেকে নবান্নসহ সব ধরণের বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংশ করার দাবী জানায়। বাউলদের চুল কেটে দেয়। পাঠ্যবই থেকে তাড়ায় ‘হিন্দু’ লেখকদের, এমনকি হিন্দুয়ানি শব্দ পাল্টে কবিতাও সংশোধন করে! হিন্দুয়ানী ভাষা বলে বাংলা ভাষাকেও তারা পাল্টে দেওয়ার দাবী জানায় সুযোগ পেলেই। আর এর বিরুদ্ধে আক্ষরিক অর্থেই সেই উন্নিশশ আটচল্লিশ সাল থেকেই আমরা লড়াই করছি। রক্ত দিয়েছি, রক্ত দেবো।

ঝামেলা এড়ানোর অযুহাতে এদেরকে তাই কোনোভাবেই ‘জিতিয়ে দেওয়া’র সুযোগ নেই। লড়াইটা এতো সহজ না, অনেক পুরনো।

বিদ্যানন্দর পোস্ট থেকেই জেনেছি মন্ত্রী এমপিরাও তাদের সহযোগিতা করেন সর্বাত্মক। বিদ্যানন্দর খাবার দূর্গম অঞ্চলে পৌঁছে দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর ট্রান্সপোর্ট এবং লোকবল। পুলিশ, বিজিবিও সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।

আর বিদ্যানন্দের পাশে আছে হাজার হাজার মানুষ, যারা এই ‘অসাম্প্রদায়িক’ বিদ্যানন্দকেই ভালোবাসে। আর বিদ্যানন্দের পাশে আছে দেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ, যারা বিদ্যানন্দর মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। বিদ্যানন্দের কিছু হলে যারা সত্যি সত্যি ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।

এই যে এতো এতো মানুষ বিদ্যানন্দকে আপন করে নিয়েছে, তারা কিন্তু কিশোর কুমার দাস হিন্দু না মুসলমান না বৌদ্ধ না খৃষ্টান না কালো না ধলো না কি… এসব দেখতে যায়নি।

এই এতোকিছু থাকতে কয়েকটা নরকের কীটের কাছে হেরে যাওয়ার অভিনয়টুকুও করার প্রয়োজন নেই বিদ্যানন্দর। আজকে এই ‘জয়’টা এই অপশক্তিকে সাহসী করে তুলবে আরো বড় কোনো ধ্বংশের। এরপর তারা আরো শক্তিশালী হয়ে নামবে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্য থেকে ‘মালাউন’ তাড়াতে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কোনো সনাতন ধর্মাবলম্বী নিয়োগের প্রতিবাদ করবে তারা।

কিশোর কুমার দাসের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ভাই… ব্যাপারটা এতো সহজ না, এতো সরলভাবে চিন্তা করার সুযোগ নাই। ব্যাপারটাকে একটু জটিল আর রাজনীতি দিয়েই বিবেচনা করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নাই।

‘বিদ্যানন্দ’ আসলেই এখন আর কিশোর কুমার দাসের নাই। এটা এখন আমাদের সবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকা যে মেয়েটা দুটো টিউশনি করে হাতখরচ চালায়, করোনার দুর্দিনে যার টিউশনিও ছুটে গেলো, তারপরও বিকাশে সঞ্চিত সবটুকু টাকা ‘বিদ্যানন্দ’ ফান্ডে জমা দিয়ে ফোনটা বুকে চেপে ধরে একটুখানি কেঁদে নেয়… বিদ্যানন্দ এখন তারও। যে ছেলেটা নিজের ঘরে পানির গ্লাসটি উল্টে তৃষ্ণা মেটায় না, কিন্তু বিদ্যানন্দের ডাকে ড্রেন পরিষ্কার করতে নামে… বিদ্যানন্দ এখন তারও।

আর এই যে দেশের হাজার হাজার মানুষ আজকে বিনা প্রশ্নে বিনা দ্বিধায় নিজের সবটুকু উজাড় করে দেয়… তা শুধু আপনার ডাকেই। আপনার নিজের সিদ্ধান্তে সরে যাওয়ারও তাই কোনো সুযোগ নেই। এখন এই হাজার মানুষের ডাকও আপনাকে শুনতে হবে।

আমি হতদরিদ্র মানুষ, বিদ্যানন্দের ফান্ডে আমার অংশগ্রহণ এতোটাই সামান্য, যে সেটা লেখার যোগ্য না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমার সামর্থ আছে বিদ্যানন্দর হয়ে মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে সর্বস্ব উজাড় করে লড়ার। এ লড়াইটাই করে আসছি বছরের পর বছর ধরে। আমৃত্যু করে যাওয়ার শক্তি আছে।

কিশোর কুমার দাস, আমার অনুরোধ আপনি কোনো অপশক্তির কাছে না হেরে সামনে আসুন, আমি আপনার পাশে দাঁড়ালাম… আমি নিশ্চিত অসংখ্য মানুষ আপনার পাশে দাঁড়াবে… এই মানুষগুলো একত্র হলে কী অসাধ্য সাধন করা যায় তা আপনি বিদ্যানন্দ দিয়েই বুঝেছেন… আরো একটা অসাধ্য সাধন করুন… আমার এটুকু ছোট্ট অনুরোধ।

আমি আপনার পাশে নিজের উপস্থিতি জানান দিলাম… উপস্থিত স্যার…

০৫ মে ২০২০ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত

comments powered by Disqus