গনি আদমের ক্যাম্পাস: জাবির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ইতিবৃত্ত

গনি আদমের ক্যাম্পাস: জাবির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ইতিবৃত্ত

১.
সহকর্মী মুম রহমান ভাইয়ের উছিলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষ করে নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের রেগুলার আড্ডা হতো তখন অফিসে। সেই আড্ডাতেই সম্ভবত প্রথম শুনি খবরটা, সেঞ্চুরি মানিকের কীর্তি। শুনে অবাক হয়ে যাই, বিস্ময়ে হতভম্ভ হয়ে যাই। জাবির তখনকার ছাত্রলীগের সেক্রেটারি মানিক আর তার সহযোগিদের ধর্ষণ সেঞ্চুরী পালনে পুরো জাতি স্তব্ধ হয়ে যায়।
আর ফুঁসে ওঠে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীরা। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে তখনকার সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারসমৃদ্ধ ধর্ষক গ্রুপ বিতাড়িত হয় ক্যাম্পাস থেকে।

নব্বইয়ের অবিস্মরণীয় বিজয়ের পরও লোভের আগুনে যে প্রাপ্তিগুলো হারিয়ে যাচ্ছিলো, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় আন্দোলনের পরেও যখন ঘাতকদের কিছুই করতে পারছিলাম না, চারদিকে শুধু হতাশা জমছিলো, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এই বিজয় নতুন করে আশার সঞ্চার করেছিলো আমাদের মনে।

সেই আন্দোলন নিয়েই ‘গনি আদমের ক্যাম্পাস’ নামে উপন্যাস লিখলেন আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রাশেদ মেহেদী। প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ।

২.
ক্যাম্পাসে গনি আদমের প্রথম দিন থেকেই উপন্যাসের শুরু। আপাত আনস্মার্ট গনি আদম ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে থাকে। বিশেষ করে শিবিরের দুই ক্যাডারকে খালিহাতে একাই ধোলাই করে সবার গুরু হয়ে ওঠে গনি আদম। এককালে ছত্রমৈত্রী করা, সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা গনি আদম ক্যাম্পাসে প্রত্যক্ষভাবে কোনো দলের হয়ে কাজ না করলেও বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আর আমিন বাজারে ট্রাক ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভে হঠাৎ করেই নেতা হয়ে যায় গনি আদম। কিন্তু গনি আদম শুধু একাই নেতা, তার কোনো নির্দিষ্ট কর্মী নেই। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই তার কর্মী।

রাশেদ মেহেদী গল্পের ছলে তুলে ধরেন জাবির ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক নেতা, ছাত্র নেতাদের অন্তরালের খবরগুলো। উঠে আসতে থাকে টেন্ডার রাজনীতির কাছে মাথা নত করা শিক্ষক আর ছাত্রনেতাদের কথা। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে ভণ্ডদের মুখোশ বদলের কথা। আর আড়ালে আবডালে উঠতে শুরু করে ধর্ষণের কথা।

শুরু হয় ধর্ষণের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার গল্প। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পুরো গল্পটা তিনি তুলে ধরেন উপন্যাসে। ধর্ষকরা বিতাড়িত হয়, কিন্তু ধর্ষণ কি থামে? থামে কি টেন্ডার আর লোভের রাজনীতি? দখল আর ক্ষমতার রাজনীতি?

ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের চিত্র দেখতে দেখতে আমরা দেখি ধর্ষণ আসলে সর্বত্রই। আমাদের মগজে, চিন্তায়, চেতনায়, নীতিতে… সবকিছুই আজ ধর্ষিত। চারিদিকে শিশ্নসভ্যতার জয় জয়কার।

৩.
গনি আদমের ক্যাম্পাস উপন্যাস হলেও, রাশেদ মেহেদী আসলে আন্দোলনটির ধারাবর্ণনাই করে গেছেন কেবল। একের পর এক তুলে দিয়েছেন ঘটনাগুলো। তাতে একটা উপকার হয়েছে, আন্দোলনের মোটামুটি একটা ডকুমেন্টেশন হয়ে গেলো।
শুধু চরিত্রের নামগুলো বদলে দিয়েছেন লেখক। সেঞ্চুরী মানিক তাই উপন্যাসে হাজির হন হিটলার নামে। এমনি করে তখনকার অন্য ছাত্রনেতারা, ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক, সাংবাদিকরা সশরীরেই উপন্যাসে হাজির থাকেন ভিন্ন ভিন্ন নামে। নাম ভূমিকায় যে গনি আদম, তিনি যে আসলে ঐ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আবু জাঈদ আজীজ তা লেখক নিজেই স্বীকার করে নেন। অনুমান করি সাংবাদিক চরিত্রের আড়ালে লেখক নিজেই হাজির হয়েছেন উপন্যাসে। কবি সুনীল সাইফুল্লাহও উপস্থিত থাকেন চেতনায়।
আবার কিছু চরিত্র স্বনামেই এসেছেন। যেমন সেলিম আল দীন, আনু মোহাম্মদ, শামসুর রাহমান, খুশী কবির, মানস চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
সেই সুবাদেই একটা বিষয় খুব চোখে লাগলো। শিক্ষকদের যে অংশটা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলো, তাদের নাম প্রকাশ করলেও আড়ালে থেকে গেলো ধর্ষকদের পক্ষ নেওয়া শিক্ষকদের নামগুলো!

৪.
৯৮ এর সেই আন্দোলন সম্পর্কে ধারনা পেতে হলে এই উপন্যাসটা নির্ভরযোগ্য হতে পারে হয়তো। যুক্ত কিছু ছবি উপন্যাসটিকে প্রামাণ্য দলিলের আরো কাছাকাছি নিয়ে গেছে। উপন্যাস হিসেবে যতোটা, তারচেয়ে বেশি একটি আন্দোলনের ইতিহাস হিসেবেই বইটা আমার কাছে মূল্যবান হয়ে থাকবে।

তবে অসংখ্য ভুল বানান, পরের প্যারাগ্রাফ আগে আর আগের প্যারাগ্রাফ পরে চলে যাওয়া, সম্পাদনার অনুপস্থিতি… এগুলো বইটিকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে। লেখাতেও তাড়াহুড়োর ছাপ প্রচণ্ড। পরবর্তী সংস্করণে এগুলো কাটিয়ে ওঠা খুব জরুরী।

৫.
আন্দোলনের ফলে ক্যাম্পাসছাড়া হয়েছিলো ধর্ষক গ্রুপ। কিন্তু ধর্ষণ কি বন্ধ হয়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। এই উপন্যাসে একাধিকবার এসেছে কিছু শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়নের কথা। এই নরপশু শিক্ষকরা সারাদেশেই আছে। কদিন পরপরই এসব খবর পত্রিকার পাতায় উঠে আসে। অনুমান করি আরো অনেক খবরই থেকে যায় গোপন।
৯৮ এর এই আন্দোলন হতে পারে পুরো জাতির জন্য প্রেরণা। একটি ক্যাম্পাস থেকে শুধু নয়, গোটা দেশ থেকে ধর্ষক এবং ধর্ষকামীদের তাড়াতে হবে।

ধর্ষকদের বহিষ্কার করলেও তাদের কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, কাউকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায়নি। এর আগে বিএনপি আমলে ছাত্রদলের নেতারা জাবিতে ধর্ষণ সংস্কৃতির সূচনা করেছিলো। তাদেরও বিচার করা যায়নি।

সাধারণত ধর্ষিতাকেই ধর্ষণের প্রমাণ নিয়ে বিচারের সামনে হাজির হতে হয়। বারংবার মানসিক ধর্ষণের শিকার হতে হয়। কিন্তু জাবির আন্দোলনে একটা দারুণ উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছিলো। ধর্ষিতার পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ গ্রহণ করা হয় সেখানে। ধর্ষিতাকে নয়, ধর্ষকের কাঁধেই থাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায়।
এই রীতিটা উদাহরণ হতে পারে সব রকম যৌন নীপিড়নের মামলায়।

[২২ মে ২০১৩ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus