শীর্ষেন্দুর উপন্যাস ‘গয়নার বাক্স’। সেই গল্প নিয়ে সম্প্রতি সিনেমা বানিয়েছেন অপর্ণা সেন।
মূলত একটি গয়নার বাক্সকে কেন্দ্র করে গল্প। অদ্ভুতুরে গল্প।
সেই গল্প নিয়ে, সাম্প্রতিক সিনেমায় ভূতের আছড় নিয়ে, শিল্পী নির্বাচন নিয়ে, অভিনয় নিয়ে, সিনেমার নির্মাণ নিয়ে এবং আরো অনেক অনেক প্রসঙ্গ নিয়েই আলাপ করা যেতো, নাহয় বলা যেতো চারটে ভালো আর দু'টো মন্দ কথা। সিনেমাটা ভালো মন্দ মিলিয়ে আগাচ্ছিলো বেশ।
কিন্তু শেষটায় এসে মুক্তিযুদ্ধকে গয়নার বাক্সে ঢুকিয়ে, অথবা গয়নার বাক্সকে মুক্তিযুদ্ধে ঢুকিয়ে একেবারে গুবলেট পাকিয়ে ফেললো।
গয়নার বাক্সে মুক্তিযুদ্ধ কেন?
উপন্যাসটা পড়েছিলাম অনেক আগে, অনেক কিছু ভুলে যেতে পারি, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ ছিলো না। এই প্রসঙ্গটা পরিচালক অপর্ণা সেন উড়িয়ে এনে জুড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর সিনেমায়। তা তিনি করতেই পারেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিনদেশীরাও সিনেমা বানাচ্ছেন, তাও আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক অপর্ণা সেন। খুশি হওয়ারই কথা। সাধু।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেন জরুরী অথবা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলো গয়নার বাক্সে? এই খুঁতখুঁতটা থেকেই গেলো শেষ অব্দি, এখনো অব্দি।
উপন্যাস এবং সিনেমার মূল চরিত্র সোমলতার স্বল্পকালীন লাজুক প্রেমিক যে কিনা প্রতি ভোরে সোমলতার দরজার সামনে রেখে যেতো একটি লাল গোলাপ। পরিচালক তাকে বানিয়ে দিলেন (তৎকালীন) পূর্ববঙ্গের কবি। সিনেমার শেষে যার আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। কিন্তু পাওয়া যায় গোলাপের পাপড়ির সমারোহে তার কাব্যচিঠি, সোমলতাকে নিবেদিত কবিতা। তা দেখে সোমলতা আকুল। যে স্বামী আর পরিবারের জন্য এতো শ্রম জীবনপণ, সব ভুলে সিনেমা শেষ হলো সেই পূর্ববঙ্গীয় কবির কল্পিত বাহুডোরে।
[পরিচালক অপর্ণা সেন]
মাঝখানে আরো আছে। সিনেমার শেষ অংশে অর্থাৎ গয়নার বাক্সের তৃতীয় প্রজন্মের স্বত্ত্বাধীকারি চরিত্রটির উপন্যাসে নাম ছিলো বসন, সিনেমায় তিনি হয়ে যান চৈতালী। উপন্যাসে যিনি ভালোবাসেন বান্ধবীর এক বিলেত পড়ুয়া জ্ঞানী ভাইকে (আশাকরি স্মৃতি প্রতারণা করেনি)। সিনেমায় তিনি ভালোবাসেন বেনু নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। বেনু শুধু একা না, তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশে রীতিমতো অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেন। গুলি খেয়ে আহত হন। পশ্চিমবঙ্গেরই কোনো একটা পোড়োবাড়িতে লুকিয়ে থাকেন দলেবলে। সেই পোড়োবাটি আবার সোমলতার সেই হারিয়ে যাওয়া কবি প্রেমিকের। যেই বাড়ির ড্রয়ার থেকে উড়ে এসে চৈতালীর কোলে জুড়ে বসে কোন অতীতের এক চিঠি, আবিষ্কৃত হয় গোলাপের পাপড়ি জড়ানো চিঠিভাণ্ডার। কন্যা মায়ের হাতে তুলে দেন সেই চিঠিস্তুপ, বিনিময়ে গয়নার বাক্সটি দান করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। কেননা “এরা মুক্তিযুদ্ধটা বোধহয় আর বেশিদিন চালাতে পারবে না, সম্বল বড় কম, মুক্তিযোদ্ধারা শুধু মরছে খানসেনাদের হাতে, ডাক্তার নেই আর্মস নেই ওষুধ নেই…।” গয়নার বাক্সেই রক্ষা অবশেষে।
মাঝখানে এক লাইনে দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন সকলই উঠে আসে সেলুলয়েডের অডিওতে। আর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
উপন্যাসের মিষ্টিপ্রেম সিনেমায় হয়ে যায় মহান পরদেশপ্রেম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় অবদানের দলিল হয়ে থাকে অপর্ণা সেনের গয়নার বাক্স।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান মোটেই কম না, অনেক বেশি অবশ্যই। সশ্রদ্ধ চিত্ত্বেই তা স্মরণ করি।
এও জানি কোলকাতাসহ ভারতের অনেকেই নিজেদের সম্বল তুলে দিয়েছিলেন, পথে পথে গান গেয়ে চাঁদা তুলে সাহায্য করেছিলেন বাঙালি শরনার্থীদের। অনেক তরুণ তরুণী রাত দিন সেবা দিয়েছেন শরনার্থী শিবিরগুলোতে। এগুলোর কিছুই অস্বীকার করার নয়। অবশ্যই অনস্বীকার্য মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যখন চলছে নকশালবাড়ি আন্দোলন, শ্রেণীশত্রু খতম। ক্রসফায়ারে প্রাণ হারাচ্ছে তরতাজা তরুণেরা। তখন সেই ভয়াবহ সময়ে তরুণরা বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করছেন! প্রাণ হারাচ্ছেন!
খটকাটা গেলো না।
[শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়]
এর মধ্যে ভূত হয়ে যাওয়া পিসিমা আবার নিজের জন্মভিটা ফরিদপুরের জমিদারবাড়িতে ঘুরেও গেছেন। যেখানে পাকিরা আস্তানা গেড়েছে। সেই পাকি সেনা ক্যাম্পের যে ভিজ্যুয়াল দেখা গেলো, তা বেশ হাস্যকর হয়ে গেছে।
কিন্তু তবু একটা খটোমটোখটোমটোতে সিনেমা দীর্ঘ হয়ে যেতে থাকে। বার বার শুধু মনে হয় গয়নার বাক্সে একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অথবা জোর করে মুক্তিযুদ্ধকে কেন আনতে হলো?
মাস কয়েক ধরেই দুই বাংলার চলচ্চিত্র ব্যক্তিরা দল বেঁধে দুই বাংলাতেই সভা সেমিনার করছেন। দুই বাংলার সিনেমা আদান প্রদানের বিষয়ে বলছেন, ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মন্ত্রী, পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, পরিবেশক সমন্বয়ে বেশ কয়েকটা বৈঠক হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অপর্ণা সেন কি সেই পথেই এগিয়ে থাকলেন কিছুটা?
গয়নার বাক্স তাই হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা?
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের এতো অসাধারণ সব গল্প আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, সেগুলো নিয়ে অনেক সুন্দর সিনেমা তৈরি হতে পারতো। গয়না বাক্সকে বলি দিতে হতো না।