১.
আব্বা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন বুঝলাম নিজের বাবা জীবনে একবারই মরে। অন্যের বাবারা মরে প্রতিদিন।
আমাদের এক কাজিন ছিলো, আমার মামাতো ভাই, রাজু। আম্মার অনেক প্রিয়। একদিন মারা গেলো রোড অ্যাকসিডেন্টে। আম্মা মর্গে পর্যন্ত গেলো, আমাকে বললো ডোমকে অনুরোধ করতে, যেন বেশি কাটাছেঁড়া না করে।
আমি শুনে হাসি। অবুঝ অনুরোধ। ডোমের কোনো কাজিন নাই, মাতা পিতা নাই, লাশ কাটা ঘরে সে কেবল একজন ডোম। নির্বিকারে মানবদেহ কাটা যার পেশা। জুতো সেলাইয়ের মতোই যে এফোঁড় ওফোঁড় করা বুক জোড়া দেয় বিড়ি টানতে টানতে।
পৃথিবীটা এমনই, এরকমই। অসংখ্য মৃত্যু চারপাশে নিয়ে আমরা হাসি পুষ্পের হাসি। সংবাদপত্রের পাতায় ছোটোবড় অসংখ্য নিউজ, মৃত্যুভীষণ নিউজ পড়তে পড়তে আমরা চা পান করি, তারপর স্টার সিনেপ্লেক্সে যাই, সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি, আলো জ্বালাবার দায় থেকে বাঁটতে নয়, আলো ঝলমলে জীবনেরই ডাকে।
২.
গত কয়েক মাস ধরে আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিক্ষক, একজন পিতা এ জে এস এম খালেদ-এর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে চেষ্টা করছি বিভিন্ন মাধ্যমে। এতো বিশাল অঙ্কের টাকা সোজা কথা না। কিন্তু নিকট অতীতেই দেখেছি সবাই মিলে চেষ্টা করলে এটা খুব কঠিন কিছুও না।
কিন্তু আসলে খুব কঠিন।
সবার আগে একটা লেখা দরকার, কোনো একটা বড় দৈনিকে, বড় একটা আবেদন। আমরা অতীতে দেখেছি এসবে খুব কাজ হয়। আমরা সেই চেষ্টায় এর কাছে যাই, তার কাছে যাই… যাদের একটুখানি লেখায় অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে, তাদের কেউ লেখেন না। দেখছি, লিখবো তবে সময় লাগবে, ইনফর্মেশনগুলো আমাকে পাঠিয়ে দাও… এসব করতে করতে মাস যায়। নিজেকেই প্রবোধ দেই, তাদেরই বা দোষ কী? তাদের কাছে প্রতিদিন এতো এতো অনুরোধ আসে, কোনটা তারা রাখবে? কোনটা রাখবে না?
তারাও যে ডোমের মতোই, এটাও তাদের কাছে কেবল একটা সাহায্যের আবেদন মাত্রই। অন্য কিছু না।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় অসংখ্য অদরকারী নিউজপ্রিন্ট দেখি। আর মনে মনে ভাবি, এগুলো নিশ্চয়ই এই জাতির জন্য বিশেষ প্রয়োজন। জাতির মানসিক বিকাশের জন্য। এই জাতির জন্য সত্যিই এখন আর মুক্তিযোদ্ধার দরকার নাই। তাদের ডিউটি শেষ। পথে ঘাটে ভিক্ষা করে কতো মুক্তিযোদ্ধা জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই তুলনায় খালেদ চাচা তো বেশ সুখেই আছেন!
আবারো নিজেকে প্রবোধ দেই, পত্রিকাগুলোই আসলে কী করবে? তারাও যে ডোমই… অসংখ্য লাশের ভীড়ে কোনো লাশই আর আলাদা পরিচয় বহন করে না।
কাল সকালে ফোনে জানলাম দৈনিক যুগান্তরে আমার ছবি আর ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটা কিনলাম রাস্তা থেকে। একবার দেখেই চরম প্রহসন মনে হলো। নিজের উপর ঘেন্না হলো।
হায়, কী অভাগা এই দেশ, যেখানে একজন মৃত্যুপথযাত্রী মুুক্তিযোদ্ধার চেয়ে একজন বেকুব নাট্যকার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সত্যিই খুব হতাশার… খুব হতাশার। পত্রিকা এতে আমার সম্মান দিলো না অসম্মান দিলো?
আমি অপমানিতই বোধ করলাম আসলে…
তারপর সেই পত্রিকা তারেকের ব্যাগে লুকায়ে খালেদ চাচাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম, ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। এটা সেটা ভিডিও করলাম একটা ডকু বানাবো বলে। তারপর বিকেলে আবার তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে আমার আর তারেকের অপেক্ষা… কিছু বিখ্যাত মানুষ, যাদের সামান্য একটা মন্তব্যই হয়তো মহিমান্বিত করবে এই ডকুটাকে। যারা সকালেও কনফার্ম করেছে বিকেলে সময় দেবেন বলে। আমরা সেই আশায় যথাসময়ে ফোন করি।
বিকেল চারটার সময় একজন জানান, তিনি সময় করে উঠতে পারছেন না আজকে। আরেকদিন হয়তো হতে পারে। সারাদিনের ক্লান্তি মেখে ম্লান হেসে তারেকের দিকে তাকাই। ‘কী আর করা’ হাসি দিয়ে এই সময়টা কিভাবে কোথায় কাটানো যায় চিন্তা করতে করতে আজীজে যাই।
টুটুল ভাই নাই, জ্বর। তার দোকান দখল করে বসে বসে ক্লান্তির ঘুম তাড়িয়ে অপেক্ষা করি পরের জনের। ৫টায় যিনি সময় দেবেন তার জন্য।
ঠিক ৫টায় তিনিও ব্যস্ততার কথাই বলেন। আমরা হতাশায় বুক বেঁধে বসে থাকি চুপ করে। এর তার সাথে আড্ডা মেরে সময় আর ক্লান্তি কাটাই। আর অপেক্ষায় থাকি ৬টায় একজন সময় দেবেন বলেছেন, তার অপেক্ষা এবার।
ঠিক ৬টায় তিনিও জানান কোনো এক সরকারী বড় আমলা তার বাড়িতে হুট করে এসে হাজির হয়েছেন। আমাদের বরাদ্দ সময় বাতিল হয়।
আমি আজীজের বারান্দায় বসে বসে অস্তায়মান সূর্য আর তার পাশে দণ্ডায়মান উঁচু টাওয়ারের ছবি তুলি। কৃষ্ণচূড়ার ছবি তুলতে গিয়ে দেখি আলো কমে গেছে, উজ্জ্বলতাটুকু আর ধরা যাচ্ছে না।
তারপর বসে থাকি চুপচাপ… চুপ চাপ… চা খাই… আবার বসে থাকি।
সন্ধ্যার পর আরো কিছু শুট করার কথা ছিলো। একে একে বাতিল হয় তাও। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি চলে আ।ি বাড়ি এসে দেখি ফেইসবুক আর ব্লগ ভর্তি অসংখ্য হাসিমুখ…
সেইসব হাসিমুখের ভীড়ে নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। চেয়ে চেয়ে দেখি কেবল… আজকাল ফেইসবুকে দেওয়ার মতো স্ট্যাটাস খুঁজে পাই না।
নিজেকেও ডোমের মতোই মনে হয়। এইসব অসংখ্য মৃত হাসিদের ভীড়ে সব হাসিকেই একই রকম প্রাণহীন মনে হয়…
পৃথিবীটা প্লাস্টিকে ভরে গেছে…