ত্রিশ বছর আগে লেখা বর্তমান সময়ের গল্প

ত্রিশ বছর আগে লেখা বর্তমান সময়ের গল্প

ডব্লিউ এইচ: যেমন দরিদ্র আপনাদের দেশ, তেমন দরিদ্র রাজনীতি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা। একজন জীবিত রাজনীতিবিদের সম্পর্কে শেষ কথা আপনারা কি করে বলেন? আজ আমি শেখ মুজিব বা ভাসানী বা জিয়াউর রহমানের চেয়ে অনেক খাটো ইমেজের রাজনীতিবিদ সন্দেহ নেই, কিন্তু ধরুন, আগামীকাল যদি বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়ায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশের সংবিধান যদি ইসলামী ধারায় নতুনভাবে লেখা হয়, আপনাদের তথাকথিত এই রাজাকার-আল বদররাই যদি দেশ শাসনে ন্যস্ত হয়, তাহলে ইতিহাস কী লিখবে আমার বা আমাদের সম্পর্কে? রাজনীতিতে শেষ কথা ওরকমভাবে লিখতে নেই।

ডব্লিউ এইচ: ধন্যবাদ পরে দেবেন। আগে বলেন একটা বিদেশী কাগজে আমাদের হয়ে নিয়মিত লিখতে রাজী কি না। লিখতে হবে একটু ক্রিটিক্যালি, তবে অবশ্যই পয়েন্ট অব ভিউ হাইলাইট করে। বুঝলেন না একটু ক্রেডিবিলিটি রেখে আর কি। রাজি কিনা বলেন। ইটস আ ডিল। ঐ কাগজে আপনার লেখার ব্যবস্থা আমরাই করে দেব।
বললাম: কিন্তু স্যার, আপনার ব্রিফিং নিয়ে আপনাদের জন্য লিখতে বসে যদি আমার মত আর বিশ্বাসের কথা লিখে ফেলি? আপনি তো নিজেও জানেন আমি মুক্তিযোদ্ধা।
ডব্লিই, এইচ বলেন: আপনি মুক্তিযোদ্ধা বলেই তো আপনাকে দরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধা, আপনাদের ভাষায়, রাজাকার আল বদরদের রাজনীতি হাইলাইট করে লিখছে- ভাবতে পারেন কী দারুণ দাঁড়াবে ব্যাপারটা? রাজী হয়ে যান সায়েব। ডিল নিয়ে তাহলে আলোচনা করি।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট শোক আর দুঃখ জানাতে গিয়েছিলাম আওয়ামী লীগের একজন নাম-করা নেতার কাছে। এই নেতা বক্তৃতা দিতেন যে, জীবনে আমাদের সৌভাগ্য বলতে হয়তো তেমন কিছু নেই। কিন্তু আমাদের পরের জেনারেশনের কাছে আমরা অন্ততঃ এইটুকু বলে যেতে পারবো যে, আমরা মুজিবের সময়ে জন্মগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের সন্ধ্যায় তার কাছে গিয়েছিলাম শোক আর দুঃখ জানাতে। গিয়ে দেখি মিষ্টান্ন বিতরণ করা হচ্ছে। তার ঘরে জনা ছয়-সাত লোক। তাদের কাছে তিনি ডিকটেটর মুজিবের হত্যার যথার্থতা আর মহান গণতন্ত্রী খোন্দকার মোশতাকের বাস্তব নেতৃত্বের প্রশংসা করে খুব উত্তেজিত ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমাকে দেখে সেই নেতা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন: কী, বাকশালে জয়েন কইরাছিলেন, নাকি করেন নাই? হ্যাঁ? কোথায় গেল বাকশাল? কোথায় গেল মুজিব?

বললাম: তোমার মতলবটা কি?
হে হে করে হাসিব বলে: পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশের পলিটিক্স বদলায়া গেছে, বুঝলা? পলিটিক্স করতে হইলে এখন ইসলামী ওয়ার্ল্ডের একটা কানেকশান দরকার। খবরা-খবর যা পাইতেছি তাতে দেখা যায় তোমাগোর ডব্লিউ, এইচই এখনকার পলিটিক্সের আসল লোক। সে-ই ইসলামী ওয়ার্ল্ডের মেইন কন্টাক্ট। তার কথা ছাড়া মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ার উপায় নাই। বুঝলা তো, এই কন্টাক্টটা আমার জন্যে একটু ম্যানেজ করো…
বললাম: ডব্লিউ, এইচ মানে একাত্তর সালে রাজাকার বাহিনীর যিনি নেতা ছিলেন?
হ হ! তুমি যার কথা একাত্তর সালে এশিয়া জার্নালে সবিস্তারে লিখছিলা।
ডব্লিউ, এইচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি চায় জানো?
একটু ইসলামী জিনিস-টিনিস চায় আর কি। তাই না?
বললাম: ডব্লিউ, এইচ মনে করেন ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ ভুল করেছে। সেই ভুলের কাফফারা আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশকে দিতে হবে। রাজী আছ কাফফরা দিতে?
মানে?
মানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার যে মারাত্মক ভুল এটা স্বীকার করতে হবে। স্বীকার করতে হবে শেখ মুজিব একটা বেঈমান। টু নেশানস থিয়োরীই সঠিক। রাজী আছ?
হাসিব একটু সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে: তার মানে এগেইন পাকিস্তান?
তা আমি জানি না। টু নেশানস থিয়োরী বলতে এক হুকুমতের আওতায় দুটো মুসলিম রাষ্ট্রই বুঝায় বটে।
হাসিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। বেশি রকম সিরিয়াস হয়ে গেলে যা হয় ডান চোখ ছোট আর তীক্ষ্ন হয়ে যাওয়া, তার তাই হল। বলল: তা জিনিসটা তো ধরো কিছুটা তাই। আমরা যেইখানে মেজোরিটিই মুসলিম সেইখানে রাষ্ট্রটাও যে মুসলিম হওয়া দরকার তাতে আর সন্দেহ কী! ইন্ডিয়ার সঙ্গেও আমাগোর কোন বনিবনা হইব না। আমাগোর দেশটারে ইন্ডিয়া তার মার্কেট বানাইতে চায়, বনিবনা হইব কেমনে? কিছু মনে কইরো না দোস্তো! ইন্ডিয়ার ডিজাইন একটু খারাপই। হেজিমনেস্টিক হাব-ভাব। ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়া শেখ সাহেব যে ভুল কইরাছিলেন আমার তাতে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্য তারে আমি বেঈমান কমু না। যারে কয়, না জাইনা না বুইঝা ভুল করা, তাই তিনি কইরছিলেন!
বুঝলাম হাসিব প্রায় তৈরি হয়ে আছে। আজ হয়তো শেখ মুজিবকে বেঈমান বলতে পারবে না, আগামীকাল ঠিক পারবে। এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়াটা ভুল বলে স্বীকার করতে পারছে না, তার সম্ভম-বোধে এখনো বাঁধছে, কিন্তু আগামীকাল তাও পেরে যাবে হাসিব। মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ার জন্যে যে পলিটিক্সের সঙ্গে স্ট্র্যটেজি মেলাতে হয় তা সে বিলক্ষণ বুঝে গেছে। এই হাসিব পারবে।
বললাম: পাছার কাপড়টা তুলতে পারবি হারামীর বাচ্চা? এই কথাটা আমি বললাম নিজেকে, মনে মনে। আমার স্কুলে পড়া সেই ছোট ভাইটার মুখে ঠিক এসময় একটা বুটের সজোর লাথি এসে পড়ল। একটা পাকিস্তানী কুত্তার বীভৎস মুখ মনে পড়ল।

[হে শূন্যতা বইয়ের প্রচ্ছদ]

হাসিব বলল: আমার হইল কোনরকমে একটা মিনিস্টার হওয়ার ব্যাপার! তুমি আমারে জাস্ট লীডারের সাথে পরিচয়টা করায়া দাও, তারপরে দেখো আমি কি ভেল্কিবাজী করি। রাজাকাররা কিসে সন্তুষ্ট হয় তা আমি জানি বুঝলা। শেখ মুজিবরে বেঈমান কইবা, পাকিস্তান ভাঙার জন্যে গভীরভাবে একটু দুঃখ প্রকাশ করবা, জিন্নাহ’র নাম বলার সময় কায়েদে আজম কইবা, ব্যস, গ্রাউন্ড ওয়ার্ক হয়া গেল। তারপর দরাদরি আছে, ওগো পার্টি ফান্ডে টাকা ডোনেট করার ব্যাপার আছে, ইসলামিক ফ্রন্টের দু'একটা ইস্যুর ব্যাপারে কনসেন্ট দিতে লাগবে, এন্ড গেমের জন্যে আমি বিলকুল তৈরি। তুমি খালি আমারে এট্টু নিয়া চলো, বাদ বাকি সব আমার ওপর ছাইড়া দেও।
ডব্লু এইচকে টেলিফোনে পাওয়া গেল। খুব দিলদরাজ গলা। খুব আন্তরিকভাবে কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন।
বললাম: আমার এক বন্ধু আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। নিয়ে আসব একদিন আপনার বাসায়?
ডব্লু এইচ বললেন: নিশ্চয়ই! একটু ব্যস্ত আছি, তা নইলে আজই আসতে বলতাম। আগামীকাল চারটার দিকে আমাদের সেন্টারে নিয়ে আসুন। তা কি করেন আপনার বন্ধু?
রাজনীতি করেন। একাত্তর সনে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। এখন খুব অনুতপ্ত। আলাপ করলেই বুঝতে পারবেন।
হা হা করে হাসলেন ডব্লু এইচ। বললেন: আপনার সব মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরাই এখন অনুতপ্ত। আপনি শুধু তেরিয়া থেকে গেলেন! আপনাকে দুরস্ত করা গেল না।
বললাম: সব মুক্তিযোদ্ধার কথা বলবেন না দয়া করে। সব জাতের মধ্যেই কিছু শুয়োরের বাচ্চা আছে। আছে না? আমি নিজে এবং আমার কিছু কিছু বন্ধু ঐ জাতের বটে। কিন্তু মনে রাখবেন সবাই নয়। মুক্তিযোদ্ধারা আবার লড়াই করতে রাস্তায় নামবে একদিন প্রয়োজন হলে।
ডব্লিউ এইচ: বাই দা বাই, আপনি তো আমাদের অফারটা নিলেন না, আপনার বন্ধুরা সেটা লুফে নিয়েছেন। এসেও ছিলেন দিন পাঁচেক আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে। একটু ছেলে-মানুষ বটে, আপনার মত কায়দা করে লিখতে পারবে না। তবে আমাদের তো পাবলিসিটি ফ্রন্টে প্রচুর লোক দরকার। তাই শোভন বাবু আর রেজা সাহেবকে নিয়েই নিলাম। আগামী মাস থেকেই ওরা আমাদের সেন্টারে ফুল টাইম জয়েন করবেন।
কে বললেন? শোভন লাল আর রেজা মুহম্মদ?
ঠিক তাই। শোভনলাল আউর রেজা মুহম্মদ। টেলিফোনে একদিন আপনাকে খোঁজ করতে গিয়ে আলাপ হয়ে গেল। কথাবার্তায় ব্রিলিয়ান্ট ধরণ দেখে আবার মুক্তিযোদ্ধা শুনে ওদের বললাম একদিন আমার এখানে আসতে। মিথ্যে কথা বলব না। ছেলে দু'টো ভালো। পরিষ্কার বলল, পয়সার জন্য কাজ করতে রাজী। একে মুক্তিযোদ্ধা তার ওপর একজন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধা,- আমাদের পাবলিক ক্রেডিবিলিটি'র জন্য ওমদা জিনিস, বুঝতেই পারেন কী খুশীটাই হয়েছি!

[রাহাত খান]


বাংলা একাডেমি যখন বইমেলা থেকে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিচ্ছে, ঠিক তখন পড়ছিলাম রাহাত খানের উপন্যাস ‘হে শূন্যতা’। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ছোট একটি উপন্যাস। যার ঘটনাকাল ১৯৮০-৮১, আর প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়কাল। মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার ছোট একটি উপন্যাসে রাহাত খান চমৎকারভাবে এঁকে রেখেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়ের পট।

মুক্তিযোদ্ধা মীর্জা আতিকুল্লাহকে কেন্দ্র করে ‘হে শূন্যতা'র কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে। যুদ্ধের পরে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটারের কাজ করে আতিকুল্লাহ। পাশাপাশি আবৃত্তি, টিভি উপস্থাপনা, বিদেশী পত্রিকায় লেখালেখি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তার একটা পরিচিতি আছে। উপন্যাস শুরু হয় এই আতিকুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ যখন একটি বিদেশী জার্নালে ডব্লিউ এইচ নামের একজনের সাক্ষাৎকার ছাপে। যে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ছিলো, এখনো মনে প্রাণে পাকিস্তানী। এবং মনে করে ভারতের ষড়যন্ত্রে আর শেখ মুজিবের হঠকারিতায় বাঙালি ভুল করেছে মুক্তিযুদ্ধ করে। এহেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একজন লোকের ইন্টারভিউ কেন ছাপতে গেলো আতিকুল্লাহ, তার প্রতিবাদ করতে আসে তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু হাসিব।

হাসিব বলল: ডব্লিউ এইচের বাসায় ঘন ঘন তুমি যাতায়াত করো, কথাটা কি ঠিক?
ঘন ঘন না হলেও দু'একবার গিয়েছি বৈকি। কেন কি হয়েছে?
কিছু হয় নাই। মাথার ওপর চন্দ্র-সূর্য যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু আতিকুল্লাহ, তুমি এত নিচে নাইমা গেলা কেমনে? তুমি জান না ডব্লিই এইচ একাত্তরে আমাদের এগেইনস্টে ছিল?
শুধু একাত্তরে কেন? এখনও স্বাধীনতার মূল ধারার রাজনীতির তিনি বিপক্ষে। তার পরিষ্কার বক্তব্য, ভারতের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ করে আমরা ভুল করেছিলাম।
আর রাজাকার আলবদরের কিলিং স্কোয়াডে জয়েন কইরা বাঙালী জাতটা খতম করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া তিনি ঠিক ছিলেন? উত্তর দেও আতিকুল্লাহ। হাউ ডু ইউ জাস্টিফাই ইয়োর গয়িং টু দ্যাট ম্যান! ক্যান যাও ওর বাসায়? কি সম্পর্ক তোমার ডব্লিউ এইচ এর সাথে! সি আই এর দালালী যোগাড়ের ধান্দায় আছো নাকি?
বললাম: হাসিব, চা খাবে? দিতে বলব?
তোমার হসপিটাবিলিটির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। চা খাইতে আসি নাই। তোমার পরিবর্তনের কারণটা একটু জানতে পারলে বর্তে যাই।

উপন্যাসের শুরুতে যখন মুক্তিযোদ্ধা হাসিব ব্যাপক বিপ্লবী, তখন সবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়, তখন যুদ্ধাপরাধীরা আবার মাত্র ধীরে ধীরে বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে এই অবস্থান পাল্টে যেতে থাকে। হাসিব এবং অন্য অন্য অনেক তরুণ মুক্তিযোদ্ধারাই স্রেফ টাকা আর ক্ষমতার লোভে ডব্লিউ এইচদের কেনা গোলাম হয়ে যায়। তারাই বঙ্গবন্ধুকে বেঈমান বলে প্রচার করতে থাকে, বলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ভুল ছিলো।


১৯৮০ সালে যখন রাহাত খান এই উপন্যাস লিখেন, সমসাময়িক রূঢ় বাস্তব কিছু চরিত্র তিনি চিনতে পেরেছিলেন, কলমের আঁচড়ে আঁকতে পেরেছিলেন স্পষ্টভাবে। কোনো দ্বিধা ছাড়াই। এই চরিত্রগুলো কতোটা ভয়ঙ্কর ছিলো তখনকার বাস্তবতায় হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেননি, অথবা জেনেবুঝেই এদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। যা আসলে এই চরিত্রগুলোর অবস্থান এই দেশে পোক্ত করতেই সাহায্য করেছে। ত্রিশ বছর পরে আমি আজ যখন এই উপন্যাসখানি পড়ি, তখন দেখতে পাই ডব্লিউ এইচ, হাসিব, আর সেই পল্টিবাজ রাজনীতিবিদ চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশে এখন কতোটা ভয়ঙ্কর রূপে বিরাজ করছে। একে একে চোখের সামনে ভেসে আসতে শুরু করে রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা আর রক্তাক্ত স্বজনদের মৃত চেহারাগুলো। সমসাময়িক কুতর্কগুলো দেখলে বুঝতে পারি রেজা খান আর শোভনলালদের কৃতিত্ব (!)
রাহাত খানের দূরদৃষ্টি আর অন্তদৃষ্টির প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয়। জ্যোতিষির ভবিষ্যৎদ্বানীর মতো প্রায় চল্লিশ বছর আগে বলা কথাগুলো বাস্তব সত্য হয়ে এখন প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়।


এই যে যথাসময়ে মুখোশের আড়ালে থাকা মুখগুলোকে চিনতে পারা, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাহাত খান যথাসময়ে চিনতে পেরেছিলেন, বেশিরভাগই পারেননি। ফলে এরকম আরেকটা উপন্যাস রচিত হয়নি। যদি সবাই তখন এই মুখগুলো, চরিত্রগুলো চিনতে পারতো, তাহলে হয়তো দেশটা আজ এই অবস্থায় পৌঁছতো না। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এখনো অধিকাংশ মানুষই চিনতে পারছে না এই চরিত্রগুলো। অথবা চিনেও না চেনার ভান করে নিজের ফায়দা লুটের ধান্ধায় আছে। ডব্লিউ এইচ, হাসিব, শোভনলাল, রেজা খানরা এখনো আছে। আপনার আমার আশেপাশেই আছে। আতিকুল্লাহরাও আছে, তাদেরকেও চিনে সঙ্গে নিতে হবে। চিনতে না পারা, বা চিনেও না চেনার ভান করা ইত্যাদির দায় এড়ানো যায় না।


ঋত্বিক ঘটকের কথাটাই বলা দরকার: ভাবো, ভাবাটা প্র্যাকটিস করো।

[১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus