দেখা না দেখার চোখ এবং হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস

দেখা না দেখার চোখ এবং হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস

কোয়ারেন্টাইন শব্দটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় পর্তুগীজ লেখক হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসটা পড়ে। যার বাংলা অনুবাদের নাম ‘অন্ধত্ব’। অনুবাদ করেছিলেন শওকত হোসেন।

যেখানে সারামাগো একটা নগরের বর্ণনা দেন, কিন্তু সেই নগরের কোনো নাম নাই। সেই নগরে সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে এক ডাক্তার ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাতি দেখার পর হঠাৎ করেই অন্ধত্ব রোগে আক্রান্ত হন। তিনি আর গাড়ি চালাতে পারেন না। পেছনের গাড়ির ক্রমাগত হর্ন বাজানোর পর যখন সবাই বুঝতে পারে ব্যাপারটা, তখন মানবিক লোকজন তাকে ধরে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। চোখের ডাক্তার জানায় ডাক্তার সাহেবের চোখে কোনো সমস্যা নাই। তাহলে কেন তিনি চোখে শুধু সাদা একফালি রঙ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছেন না, সেই রহস্যের সমাধা হয় না। প্রশ্নবোধক মন নিয়েই তিনি বাড়ি ফিরে আসেন পরবর্তীতে উচ্চতর চিকিৎসার আশায়।

[ব্লাইন্ডনেস, হোসে সারামাগো]

ব্যাপারটা এই পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিলো। বিপত্তির শুরু হয় পরদিন থেকে। যখন জানা যায় গতকাল এই ডাক্তারের সংস্পর্শে যারাই এসেছিলো তারা প্রত্যেকেই এই অন্ধত্ব রোগে আক্রান্ত! শুধু একজন ছাড়া, তিনি ডাক্তার গিন্নী! কোনো এক অজ্ঞাত কারনে তিনি এই রোগে আক্রান্ত হন নাই!

শহরের প্রান্তে এক মানসিক রোগীদের কয়েদখানা, যাকে আমরা পাগলা গারদ বলি। আক্রান্ত লোকেদেরকে সেখানে নিয়ে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে। দূরে মাস্ক পরা মিলিটারিরা পাহারায়। বের হলেই গুলি। দূর থেকেই খাবার দেওয়া হয়। আর প্রতিদিনই দলে দলে অন্ধত্ব রোগে আক্রান্ত মানুষের ভীড় বাড়ে পাগলা গারদে। বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে।

একসময় দেখা যায় সেখানে কেউ আর আসছে না, তাদের জন্য খাবারও সরবরাহ করা হচ্ছে না। বের হয়ে দেখে তাদের পাহারা দেওয়া মিলিটারিরাও আর নাই। তারপর তারা সেই অনাম্নী নগরে বের হয়ে আসে। সমস্ত নগরবাসী তখন এই অন্ধত্ব রোগে আক্রান্ত।

শুধু সেই ডাক্তার গিন্নী ছাড়া! অথচ ডাক্তার গিন্নী প্রথম দিন থেকেই স্বামীর সঙ্গে পাগলা গারদেই থেকেছেন, কেউ জানতে পারে নাই যে তিনিই একমাত্র নিরোগ!

উপন্যাসের কাহিনীর এ পর্যায় পর্যন্ত বর্তমান পৃথিবীর সঙ্গে বেশ একটা মিল পাওয়া যায়। আমরা আশঙ্কা করতে পারি যে করোনার প্রভাবে কোয়ারেন্টাইন হতে হতে আমরাও একসময় এরকম অবস্থায় চলে যেতে পারি, যখন আসলে আর আলাদা করে লকডাউন করার দরকার পড়বে না। কারন ততোদিনে হয়তো দুনিয়ার সকলেই আক্রান্ত হয়ে যাবো আমরা।

[হোসে সারামাগো]

কিন্তু উপন্যাসটা আসলে এইখানে না, উপন্যাসটা আসলে শুরু হয় এর পর থেকে। এই যে অনাম্নী এক নগর, আর তার মানুষগুলো, যাদেরও কোনো নাম হোসে সারামাগো আমাদের বলেন না… কেউ সেখানে ডাক্তার, কেউ সেখানে ডাক্তারগিন্নী, কেউ টেরাচোখের বালক, কেউ সুন্দরী নারী ইত্যাদি… এই নগর আর তার মানুষগুলো তখন হয়ে ওঠে গোটা পৃথিবীর প্রতিনিধি। আর তারপর শুরু হয় আসল গল্প… দুনিয়ার সব লোকরে অন্ধত্ব রোগে আক্রান্ত করার পর হোসে সারামাগো পাঠকের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে থাকেন আমরা যারা চোখসর্বস্ব, তারা যে আসলে কতোটা অন্ধ! এই অন্ধত্ব কোনো দৃষ্টিবিভ্রম না, না দেখা না… অন্ধত্ব মানে মানসিক অন্ধত্ব! এই অন্ধত্বের বর্ণনা হোসে সারামাগো এতোটা তীব্রভাবে উপস্থাপন করেন, যার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। অন্তত আমি অপারগ।

[ব্লাইন্ডনেস উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের পোস্টার]

আমার পড়া সর্বকালের সর্বপ্রিয় উপন্যাসের একটা ‘ব্লাইন্ডনেস’। কিন্তু এই বই আমি কোনোদিন দ্বিতীয়বার পড়ার সাহস পাইনি। কারন সেই ভয়াবহ মানসিক পীড়ন, আমার পক্ষে দ্বিতীয়বার নেওয়া সম্ভব না। পড়া শেষ হবার পর একটা অদ্ভুত বিহ্বলতা কাজ করে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, তবু মনে হয় এই ভয়াবহ অমানবিক প্রাণীগুলোই আসলে মানুষ, নিজেরে যারা সৃষ্টির সবচেয়ে সেরা এবং জ্ঞানী প্রাণী বলতে পছন্দ করে, জাহিরও করে। এবং ঘৃণাভরে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, আমিও আসলে তাদেরই অংশ… একটুও আলাদা কিছু না!

[শওকত হোসেনের অনুবাদে ব্লাইন্ডনেস বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘অন্ধত্ব’]

যেমন আচমকা অন্ধত্ব রোগের সূচনা হয়েছিলো সেই অনাম্নী নগরে, তেমনি এক সুন্দর সকালে আচমকাই আবার মানুষ সবকিছু দেখতে শুরু করে। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার আনন্দে উদ্বেল হয় তারা। তাদের চোখে পড়ে না এই কদিনে তারা নগরটাকে কতটুকু নরক বানিয়ে ফেলেছে। শুধু সেই ডাক্তারগিন্নী, যে এই পুরোটা সময় স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি দিয়ে দেখে চলছিলো মানুষ নামের আশরাফুল মাখলুকাতের অমানবিকতা… তার মনে হতে থাকে, সবার শেষে এবার বুঝি তার পালা…

করোনা সংক্রমণের কালে আলবেয়ার কাম্যুর প্লেগ না… আমার বার বার মনে পরে হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেসের কথা। আর ততোই আঁকড়ে ধরতে থাকে ভয়…

[১৮ মার্চ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus