দেবদাস হত্যার দায় কার?

দেবদাস হত্যার দায় কার?

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস ফিরে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, ততোদিনে পাকি দালাল ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের পতন হয়েছে। সম্ভবত ততোদিনে দেশ ছেড়েই পালিয়েছে হারামজাদাটা। আরেক পাকি দালাল ভিসি মোহাম্মদ আব্দুল বারীকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ততোদিনে। বদলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘পরিকল্পনা কমিশন’-এর সদস্য, ৫২র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী, বিশিষ্ট রবীন্দ্র অনুরাগী প্রফেসর ডক্টর খান সারওয়ার মুরশিদ।

মুক্তিযুদ্ধকালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাতিক্রমী এবং অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ কাজটি করার ‘অপরাধে’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাসকে পাকিস্তান বাহিনী নির্মম অত্যাচার করেছিলো। অত্যাচার করে করে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিলো… সেই মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাসকে পরিপূর্ণ সুচিকিৎসা দিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ করে তোলা এবং সবরকম সাপোর্ট দিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলার গুরুদায়িত্ব ছিলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ভাইস চ্যান্সেলর খান সারওয়ার মুরশিদের নেতৃত্বে সমস্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাসকে নির্যাতন করেছিলো মাত্র ৪ মাস। কিন্তু ৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রিয় ক্যাম্পাসে ফেরার পরেও শিক্ষকতা করতে না দিয়ে, মাসের পর মাস অবজ্ঞা এবং অবহেলা করে খান সারওয়ার মুরশিদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে নির্যাতন করেছে টানা দেড় বছর।

৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত টানা প্রায় দেড় বছর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জুবেরী হাউজে অবস্থান এবং অপেক্ষা করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে ক্লাশ নিতে দেওয়া হয়নি! ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আদালতের মাধ্যমে এফিডেভিট করে নিজেকে ‘দেবদাস’ নামে অফিসিয়ালি নিবন্ধন করেন। এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জানিয়ে দেন। ১৫২ তম সিন্ডিকেট সভায় তাঁর নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব অনুমোদনও পায়। কিন্তু প্রশাসন থেকে এই অনুমোদনের কোনো চিঠি দেওয়া হয় না ‘দেবদাস’কে! তাঁকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা আর অবজ্ঞা করা হয়। গোটা ক্যাম্পাসে কেউ এর প্রতিবাদ করেনি!

একজন মেধাবী গণিত শিক্ষক ছিলেন তিনি। মানসিকভাবে ’অসুস্থ’ হয়ে তিনি রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করেননি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন। এই ‘পাগল’ লোকটা আদালতের মাধ্যমে নিজের নাম এবং ধর্ম পরিচয় পরিবর্তন করার মতো সুস্থ ছিলেন। এতোটুকু করতে পারলে নিশ্চিতভাবে তিনি আবারো গণিত বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের গণিত শেখাতেও পারতেন। একটু সামান্য মানসিক আর প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পেলে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস আজ দেশের গণিত ইতিহাসে নিজের মেধা ছড়িয়ে দিতে পারতেন, হয়তো। তিনি কোনো সাহায্য বা অনুকম্পা প্রত্যাশী ছিলেন না। যা ছিলো তাঁর প্রাপ্য, সেটুকুই চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন’ তাঁকে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে সম্পূর্ণ দেড়টি বছর!। প্রতিবাদে ১৯৭৩ সালের মে মাসে দেবদাস পদত্যাগপত্র জমা দেন। ‘বিব্রত’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে!

অগ্রণী ব্যাঙ্ক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় (সাবেক হাবিব ব্যাঙ্ক) অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের অ্যাকাউন্টে তখন বেশ অনেক টাকাও জমা ছিলো বলে জানা যায়। কিন্তু নাম পরিবর্তনের ‘অজুহাতে’ তাঁকে কোনোদিন সেই টাকা তুলতে দেওয়া হয়নি! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ কেউই উদ্যোগ নেয়নি এই নির্যাতীত শিক্ষকের প্রাপ্য সম্মান এবং সম্মানীটুকু ফিরিয়ে দিতে! বদলে তাঁকে কৌশলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো পাবনার হেমায়েতপুরে, মানসিক হাসপাতালে!

মেধাবী গণিত শিক্ষক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাসকে পাকিস্তান আর্মি না, রাজাকার-শান্তিবাহিনী-আলবদর-আলশামস না… হত্যা করেছে ৭২-৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রশাসন’। অথচ যেহেতু কোনো ধারালো বা আগ্নেয় অস্ত্র ব্যাবহার করা হয়নি, তাই একে হত্যাকাণ্ড বলা যাবে না। ঠিক যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনোসাইডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সাহসী এবং শক্তিশালী প্রতিবাদ করার পরেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করায় তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাও বলা যাচ্ছে না!

তাই আমরা মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস- এর হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে পারি না। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়না পত্রিকায়। শোকবাণী যায় না রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের।

কিন্তু তাঁর এই শারীরিক মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়… বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই অবহেলা, অবজ্ঞা আর উপেক্ষার পেছনে কি কোনো ষড়যন্ত্রের বীজ লুকিয়েছিলো? কেউ বা কোনো গোষ্ঠী কি এই ‘সুযোগে’ তাঁকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো? নইলে কেন এরকম বিমাতাসুলভ আচরণ করা হলো তাঁর সঙ্গে?

এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুঁজে বের করা সম্ভব এখনও… যদি ’কর্তৃপক্ষ’ চান। কিন্তু সম্ভবত কেউই ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে’ ভালোবাসবেন না।

যিনি নিজের মুসলিম নাম পরিবর্তন করে দেবদাস রেখেছিলেন, ধর্ম পরিচয় অগ্রাহ্য করেছিলেন, মৃত্যুর পর ছবিতে দেখলাম তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে ইসলাম ধর্মমতে… সারাজীবন অসম্মান করার পর মৃত্যুতেও তাঁকে অসম্মান করতে ছাড়িনি আমরা…

[২০ মে ২০২০ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus