হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচঙ উপজেলার নজিপুর গ্রাম। চারদিকে হাওরের অথৈ জল, তার মধ্যে ছোট্ট একটা দ্বীপের মতো এই নজিপুর গ্রাম। মূলত মাছ ধরাই পেশা, জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই সনাতন ধর্মাবলম্বী। ১৯৭১ সালের এক বর্ষাকাল। চারদিকে আর কোনো গ্রাম চোখে দেখা যায় না। সেদিন ছিলো বিষহরী পুজো। গ্রামে হামলে পড়লো পাকিস্তানী সেনারা, সঙ্গে রাজাকার। ৬ বছর বয়সের ছোট্ট তরুলতা, তার চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হলো দু ভাই ও স্বজনদের। গুলির তাণ্ডবে গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাই যে যার মতো ছুটে পালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? চারদিকে তো অথৈ জল।
গীতারাণী দাশের বয়স তখন ২০/২২ বছর। কোলে ছোট্ট শিশুসন্তান। অন্যদের মতো স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সন্তান কোলে তিনিও নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেও গুলি হলো। গুলিতে উড়ে গেলো কোলের সন্তানের মাথার খুলি! কিন্তু কান্নার বা শোকেরও অবসর কোথায়? স্বামী স্ত্রী দুজনের হাতে পায়েই লেগেছে গুলি। আদরের মৃত সন্তানকে হাওরের পানিতে ফেলে ছুটতে হলো নিজেদের জান বাঁচাতে।
সেদিন শহীদ হয়েছিলেন ৪০ জন। সবার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো হাওরের জলে! সেই তরুলতা, সেই গীতারাণী… ৪৮ বছর ধরে বয়ে চলেছেন এই দুঃসহ স্মৃতি।
শুধু তরুলতা আর গীতারাণী না, সমগ্র বাংলাদেশের মাটির গায়ে লেগে আছে জেনোসাইডের দুঃসহ স্মৃতি। এই বানিয়াচঙেই নজিপুরের মতো আরেকটি দ্বীপগ্রাম মাকালকান্দিতে আমরা এসেছিলাম আগের বছর। সেখানেও এভাবেই হত্যা করা হয়েছিলো শতাধিক মানুষকে, ধর্ষণ করা হয়েছিলো নারীদেরকে।
আমরা বলতে পারি শক্তি দেবী কানন আর মঞ্জু দেবী নামের দুই বোনের কথা। যুদ্ধের শুরুতে শক্তি দেবী কলেজে আর মঞ্জু দেবী ক্লাস টেনে পড়তেন। বাবার চাকরির সুবাদে থাকতেন মালনিছড়া চা বাগানে। যুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে পালাতে বাধ্য হন শ্যালা ক্যাম্পে। সেখানে শক্তি আর মঞ্জুর মতো আরো প্রায় ৫০ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। পাশেই বাঁশতলা সাব সেক্টরে ক্যাপ্টেন হেলালের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা। আহত হচ্ছেন তারা। ক্যাম্পে লেগে আছে রোগ বালাই। চিকিৎসার ব্যাবস্থা নেই। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে দুই কিশোরী বোন যোগ দেন নার্স হিসেবে। কোনো ট্রেনিং ছাড়াই হাজার হাজার মানুষ আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা সুশ্রুষা করতে থাকেন। শরণার্থী ক্যাম্পে তখন কলেরা। অকাতরে মরছে মানুষ। চিকিৎসা সেবাদানের মধ্যেই খবর এলো মা ভীষণ অসুস্থ। দুই বোন ছুটলেন মায়ের চিকিৎসায়। রাত তিনটার দিকে মৃত্যু হলো মায়ের। সকালে সৎকার করে সঙ্গে সঙ্গেই আবার ছুট ক্যাম্পে… মানুষকে সেবা করতে হবে, মায়ের জন্য শোকের সময় কোথায়?!
আমরা জানতে পারি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর জেনোসাইডের কথা, একদিনে যেখানে মৃত্যু হয়েছিলো প্রায় দেড়শ মানুষের। যাঁদের সবার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো নদীর জলে। আর গুলি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন বকুল রাণী সরকার। সত্যি কি বেঁচে গিয়েছিলেন? একে কি বেঁচে যাওয়া বলে? তখন তিনি ৮ মাসের গর্ভবতী। গুলিতে রক্তশূন্যতায় বেঁচে যাওয়া বকুল রাণী সরকার দুমাস পর যে সন্তানের জন্ম দিলেন, সেই লাভলী রাণী সরকার এই ৪৮ বছর বয়সেও প্রতিবন্ধী! হাঁটতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, কথা বুঝতেও পারেন না।
আমাদের শ্রদ্ধাভাজন সহযোদ্ধা তানিয়া মুর্শেদ। একবছর আগেই যিনি ক্যান্সার নামের মরণব্যাধীর কাছে হার মেনেছেন, সেই তানিয়া আপার মা মুর্শিদা মুর্শেদ আমাদেরকে জানান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস জুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তার দোসর রাজাকার আলবদরদের নৃশংসতার নানান বিবরণ। আমাদের মনে পড়ে যায় সেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের কথা। যার ড্রয়ারে পাওয়া গিয়েছিলো বুদ্ধিজীবীদের তালিকা, যে তালিকা ধরে হত্যা করা হয়েছিলো বুদ্ধিজীবীদের। সেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত জেনোসাইডের সাক্ষ্য দেন মুর্শিদা মুর্শেদ।
রাজশাহীতে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার সাক্ষ্য নিজের ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন রোকেয়া বেগম। এতোগুলো বছর সেই ডায়রি সযত্নে বুকে আগলে রেখেছিলেন ভাতিজি শান্তা। সেই অপ্রকাশিত ডায়েরির মাধ্যমে আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
আমরা জানতে পারি মাগুরার লুৎফুন্নাহার হেলেনের কথা। পাকিস্তান আর্মি যাঁকে জিপের পেছনে বেঁধে সারা শহরে ঘুরিয়েছিলো, গুলি করে মেরে লাশ ফেলে দিয়েছিলো নবগঙ্গা নদীতে…
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক সংঘটিত জেনোসাইডের এরকম বেশ অনেকগুলো সাক্ষ্য হাসান মোরশেদ তুলে ধরেছেন তাঁর ‘নারী সাক্ষ্যে জেনোসাইড’ বইয়ে। মোট ১২টি ঘটনার বিবরণ আছে বইতে।
[লেখক ও গবেষক হাসান মোরশেদ]
২০১৭ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত জেনোসাইডের অডিও ভিজ্যুয়াল সাক্ষ্য ডিজিটালি আর্কাইভ করার কাজ করছে 1971Archive.org । তারই ১২টি সাক্ষ্য, যেগুলো মূলত নারীদের ভাষ্যে উঠে এসেছে, এ বইতে সেগুলো তুলে ধরেছেন হাসান মোরশেদ।
এই সাক্ষ্য সংগ্রহের কাজে হাসান মোরশেদের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমিও যুক্ত ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যখন সাক্ষ্যদাতা নারীর সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়াই, যখন তাঁদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা শুনি, শুনতে শুনতে বেশিরভাগ সময়ই ইচ্ছে হয় পালিয়ে বাঁচতে। নেওয়া যায় না। কান্না চলে আসে। আমি জানি, পাঠকেরও সেরকমই অভিজ্ঞতা হবে। আমি জানি, কোনো পাঠকই এ বই একটানে পড়ে শেষ করতে পারবেন না। বারবার ঝাপসা হয়ে যাবে দৃষ্টি। বুকের কাছে জমে উঠবে বেদনার পাথর, কণ্ঠ বুজে আসবে। তবু অনুরোধ, এই বইটি পড়ুন। একটু সামান্য কষ্টেই দেশটাকে আর বাঙালি জাতটাকে গালি দেওয়ার আগে এই বইটি পড়ুন। আর কোনো বই না পড়লেও এই একটি বই পড়ুন। জানুন। এই বই পড়ার অভিজ্ঞতা হয়তো বদলে দিতে পারে আপনার জীবনবোধ, আপনার চিন্তা চেতনা। দেশটাকে, মানুষকে হয়তো নতুন করে চিনতে জানতে আর বুঝতে সাহায্য করবে এই বইটি। এই বইটি হয়তো আপনাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে…
অনুরোধ, বইটি পড়ুন।
বই: নারী সাক্ষ্যে জেনোসাইড
লেখক: হাসান মোরশেদ
প্রচ্ছদ: স্যাম
প্রকাশক: বাতিঘর
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০
মূল্য: ২২০ টাকা