নিধি

নিধি

সবচেয়ে নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, অধ্যাবসায় আর গুরুত্ব দিয়ে যে কাজটা আমি করতে পারি, তার নাম আলসেমি। এই কাজে আমার কোনো জুড়ি নেই। এই যেমন ঘরস্ত্রী আজ সকাল থেকে অন্তত দশবার এসে বলে গেছে ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিলেই যে ধোপাখানা, সেখানে ক’টা কাপড় দিয়ে আসতে। যাবো যাচ্ছি করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আনতে পেরেছি, আরেকটু পরে বলবো আজ তো রাত হয়ে গেছে, কাল নিয়ে যাবো।
প্রতিদিন রাতে আমি ঘুমাতে যাই কালকে থেকে কাজ করে ফাটিয়ে ফেলবো এই চিন্তায়। কিন্তু সকাল থেকে একটার পর একটা অকাজ সামনে আসে আর ভাবি এটা শেষ করেই কাজে বসবো। এভাবে একসময় রাত হয়ে যায়, তারপর মনে মনে বলি আজ আর কাজ করে ফায়দা নেই, তারচেয়ে একটা সিনেমা দেখে ঘুমাই, কাল একেবারে ফাটিয়ে ফেলবো কাজ করে। বলাই বাহুল্য, পরদিনও নিয়মের ব্যতিক্রম করি না।
যে কাজটা ৫ মিনিটেই করে ফেলা যায়, সেই কাজটা করছি করবো বলে ৫০ দিন পার করে দেওয়ার মহান কৃতিত্ব আমার আছে।

তো সেই আমাকে যদি বলা হয় ‘আসিতেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান আর দিতে হবে একটা ভালো নাম’। তখন আমার শুধু মনে হয়, বহুত দেরি আছে, এতো আগে নাম নিয়ে নামতা গুনে লাভ কী? আগে তো হতভাগাটা আসুক।
(দিব্যি দেখতে পাচ্ছি চেনা পরিচিত মানুষগুলো বাকী লেখা না পড়েই মন্তব্যর ঘরে ‘অভিনন্দন’ লেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছেন। তাঁদের জন্য গোঁফ পাকাতে পাকাতে বলি, সেই অভিনন্দনের গুড়ে বালি। আমি এখন ফ্ল্যাশব্যাক সিনে আছি, সাদাকালো কিংবা সেপিয়া। {সেপিয়া নিয়ে একটা গপ মনে পড়ে গেলো, সে গপ আরেকদিন হবেক্ষণ} এ নিধির গল্প, আট বছর আগের। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় ‘আট বছর আগে একদিন)

দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দুজনের নামই ‘ন’ দিয়ে। (দুর্ভাগ্যের শুরুটা কোথায় সেটা আর না বলি, ঘরে তো থাকতে হবে নাকি?) সে অনুযায়ী দাবী উঠলো সন্তানের নাম হতে হবে ‘ন’ দিয়ে, আর হতে হবে অপ্রচলিত। কই পাই? ভাবিতে ভাবিতে নাম এলো বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা। কিন্তু প্রতিদিনই ‘নাম কই’ দাবী শুনতে শুনতে অতিষ্ট হয়ে বললাম খুব ভালো একটা নাম পেয়েছি, নামের মধ্যে তিন তিনটা ‘ন’ আছে! নূপুর খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কী? আমি বললাম ‘ননসেন্স’!
এরপর আমার কপালে কী জুটেছিলো তা এখানে বলে আর ইজ্জত খোয়াতে চাই না, বিবাহিত পুরুষ মাত্রই নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন।
তবে একটা সুফলও আছে, বেশ কিছুদিন আর ‘নাম কই’ শব্দযুগল শুনতে হয় নাই। বাঁচোয়া।

কিন্তু আমার মতো একটা অপদার্থকে যে সহ্য করে নিতে পেরেছে, তাঁর ধৈর্য্য কি আর এতো তাড়াতাড়ি ফুরোয়? ফুরোলোও না। হপ্তা না যেতেই আবার মিছিল ‘নাম কই?’ আমি আবার নাম খুঁজে হয়রান হই। হবু মায়ের নামান্দোলন থেকে রেহাই পেতে এবার দুষ্টুমির মাত্রা বাড়াই।
একটা নাম পাওয়া গেছে।
কী?
খুব ভালো নাম, একেবারে আনকমন।
(খুশি আর উত্তেজনায় কম্পিত কণ্ঠ) কী?
নমরুদ!
এরপর কী হয়েছিলো সেটাও এখানে আর বলা যাচ্ছে না, এখনো বেঁচে আছি সেটা দেখতেই পাচ্ছেন।
আবারো কিছুদিন নাম খোঁজ দ্য সার্চ বন্ধ। আমিও রেহাই।
কিন্তু সংসার তো সেই লুপে আটকে যাওয়া ক্যাসেটের ফিতের মতোই একটা ব্যাপার। ঘুরে ফিরে তাই আবারো নামের প্রসঙ্গ এলো। এলো অভিমান, কান্না ইত্যাদি সঙ্গতে। আমারও মনে হলো নাহ্, বিষয়টাকে আরেকটু সিরিয়াসলি চিন্তা করা দরকার। আমি গভীর চিন্তায় বসলাম। কিন্তু দুষ্টুমির লোভ এবারও ছাড়তে পারলাম না। আবার ভয়ও করতে লাগলো। ভদ্রলোক মাত্রই নিজের স্ত্রীকে ভয় পায় আর পরস্ত্রীকে ভালোবাসে। আমি আর ব্যতিক্রম কী বলুন?
তাই ভয়, দ্বিধা, জড়তা নিয়ে অবশেষে বললাম
একটা নাম পাইছি
আবার ঐরকম না তো?
জানি না, তবে একটা সমস্যা আছে।
কী?
নামের শুরুতে ‘ন’ নাই, নামের শেষে ‘ন’। চলবো?
(ব্যাপক চিন্তিত কণ্ঠ) কী?
শয়তান!
এই প্রথম আমার পিঠ অক্ষত থাকলো। কোনো বকাবাজিও হলো না। তবে কাজের কাজ যেটা হলো, আর কোনোদিন আমার কাছে নাম চাইলো না কেউ হাসি

ঘর আলো করে ভালো সন্তান এলো, কিন্তু তবু আমার কাছে আর কেউ নাম জানতে চায় না। আমিও চুপচাপ থাকি। আত্মীয় স্বজনরা নিজ দায়িত্বে একাধিক নাম রাখতে লাগলেন, যেগুলোর অর্থ তো জানিই না, উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙ্গে যায়। আমি তাকে ডাকা শুরু করলাম চান্দু নামে (‘ন’ আছে কিন্তু)। এভাবে দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেলো। অসহায় মা আত্মীয় স্বজনের দেওয়া ‘ন’বাচক দুখানা নামকে জোড়াতালি দিয়ে একটা নাম রেখে দিয়েছে। সেটাই চলছে।

প্রথম বছর জন্মদিন। আগেরদিন দোকানে গেলাম কেকের অর্ডার দিতে। দোকানদার জিজ্ঞেস করে, কী লেখা হবে? আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কঠিন ভিনভাষার শব্দ তো উচ্চারণ করতে পারি না। তাই বলে দিলাম ‘শুভ জন্মদিন নিধি’ লিখতে। পরদিন কেক নিয়ে এলাম, নূপুর তো কেক দেখে মূর্ছা যায় প্রায়। একটু পরে অনুষ্ঠান, অতিথিরা চলে এসেছে আর তার অপদার্থ স্বামী ভুল করে অন্য বাচ্চার কেক নিয়ে এসেছে! আমি বললাম অন্য বাচ্চার না, এইটাই আমাদের কেক।
নিধি কে?
ওর নাম নিধি। ‘ন’ আছে তো।
নেহায়েৎ তখন আর তর্ক করার সময় নেই, তাই আর উচ্চবাচ্য না করে নামটা মেনে নিলো। নিধি হলো নিধির ডাকনাম। এভাবে চললো আরো কয়েক বছর। একসময় নিধির স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় এলো। নিধির মা স্কুলের ভর্তি ফর্ম আমার টেবিলে ঠকাস করে ফেলে বললো, ‘ফিলাপ করে কালকে দিয়ে আইসো স্কুলে’। ‘জ্বি আচ্ছা’। আমি সেখানে বাচ্চার নাম হিসেবে লিখে দিলাম ‘আকাশলীনা নিধি’। নিধির মা আবারো আঁৎকে উঠলো, ‘এইটা কে?’ আমি বললাম এইটাই আকাশলীনা নিধি।

দুদিন আগে ছিলো নিধির জন্মদিন। দেখতে দেখতে কত্তো বড় হয়ে গেলো মেয়েটা। শুভ জন্মদিন নিধি।

আমার আর নিধির প্রিয় কাজ হচ্ছে বৃষ্টিতে ভেজা। বৃষ্টি হলেই আমার সব আলসেমি ছুটে যায়। দুজনে গলিতে বৃষ্টিতে ভিজি আর পাড়া প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে দেখে, কারন তাদের সন্তানদের বৃষ্টিতে ভেজা নিষেধ!
আর কী অদ্ভুত, এই পোস্ট লিখতে লিখতে বৃষ্টি এলো রিমঝিমিয়ে। যাই ভিজে আসি দুজনে।

[২১ মে ২০১৫ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus