পুলিশ কর্তৃক গণধর্ষণে মৃত ইয়াসমিনের ২৫ বছর... প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি, আমাদের কিংবা ইয়াসমিনদের

পুলিশ কর্তৃক গণধর্ষণে মৃত ইয়াসমিনের ২৫ বছর... প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি, আমাদের কিংবা ইয়াসমিনদের

১.

দিনাজপুর শহরের গোলাপবাগ এলাকায় ছিলো ইয়াসমিনদের বাড়ি। গোলাপ ফুলের মতো সুন্দর কিশোরী ইয়াসমিনের বয়স ছিলো ১৪ বছর। আর সংসারে ছিলো কাঁটার মতো অভাব। সেই অভাব মেটাতে কিশোরী ইয়াসমিন, ১৪ বছরের ইয়াসমিন এসেছিলো রাজধানী ঢাকা শহরে, কাজের খোঁজে, যেরকম আসে আরো অসংখ্য কিশোরী।

কাজ সেরে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরছিলো ইয়াসমিন, ১৪ বছরের ইয়াসমিন। মায়ের সঙ্গে দেখা হবে, দেখা হবে খেলার সাথিদের সঙ্গে। সেই স্বপ্নে আর আনন্দে বোধহয় বিভোর ছিলো মন। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী এক নাইটকোচে উঠেছিলো ইয়াসমিন। নাইটকোচের সুপারভাইজার তাকে দিনাজপুরের দশমাইল এলাকায় নামিয়ে দিয়েছিলো।

দিনটি ছিলো ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট। রাত পেরিয়ে ভোর হয়নি তখনো। গভীর কালো অন্ধকারে মহাসড়কের পাশে একা এক দিশেহারা বালিকা। কোনদিকে যাবে? কোথায় যাবে সে? পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো টহল পুলিশের একটি দল, বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তারা তুলে নেয় গাড়িতে। ইয়াসমিনের চোখে তখনো বাড়ি ফেরার স্বপ্ন। পুলিশকে ভরসা না করার মতো বুদ্ধি তখনো তার হয়নি। আর হলেই বা, রক্ষা কি পেতো?

পুলিশগুলোর চোখ, হাত, মন, মগজ, লোলুপ জিহ্বা আর উদ্ধত যৌনদণ্ড এগিয়ে এলো ১৪ বছরের কিশোরী মেয়েটির শরীরে। খুবলে খুবলে খেলো। গণধর্ষণে মৃত্যু হলো কিশোরী ইয়াসমিনের। তারপর যখন রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো, তখন সেই পুলিশ নামের ধর্ষকগুলো কিশোরী ইয়াসমিনের লাশ ফেলে দিলো পথের ধারে ঢোল কলমী ঝাড়ের পাশে।

পুলিশ কর্তৃক ১৪ বছর বয়সের হতদরিদ্র কিশোরী ইয়াসমিনের এই গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি দিনাজপুরের মানুষ। আজ থেকে ২৫ বছর আগের সেই সকালে দিনাজপুরের মানুষগুলো প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো, মিছিল করেছিলো। সেই মিছিলে গুলি চালিয়েছিলো পুলিশ, তাতে মৃত্যু হয়েছিলো আরো ৭ জন প্রতিবাদকারীর। কিন্তু তাতেও দমেনি তারা। তিনদিনব্যাপী তুমুল আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলো। পুলিশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলো প্রশাসন। তারপর ৮ বছর চলা বিচারের পর পুলিশের দুই সদস্য আর সেই পিকআপ চালকের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছিলো।

সেই থেকে ২৪ আগস্ট তারিখটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ দিবস, ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’।

২.

ইয়াসমিনের আত্মত্যাগে ইয়াসমিনের প্রাপ্তী কী? মৃত্যু এবং মৃত্যুর চেয়েও অনেক অনেক বেশি অপমান নির্যাতন।

ইয়াসমিনের পরিবার পেয়েছে কিছু আর্থিক সাহায্য, যৎসামান্যর চেয়েও কম।

যে ৭ জন সাহসী প্রাণ আমাদের মতো নপুংশক আপোষী জীবনের নিজের মৃত্যু বেছে নিয়েছে, তাঁরা আর কিছু পাক বা না পাক, আমার শ্রদ্ধা সম্মান ভক্তি কৃতজ্ঞতা পাবে আজীবন।

যে তিন ধর্ষকের ফাঁসী হয়েছে, তাদের ফাঁসী হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে একটা কিশোরী শরীর যাকে ’কুমারী’ বলে ধর্ষকামরা আরো বেশি উত্তেজিত হয়, সেই শরীরকে জোর-পৌরুষে ভোগ করার যে পৈশাচিক আনন্দ এই অমানুষগুলো পেতে চায় বলে ধর্ষণ করে, তার তুলনায় ফাঁসীর শাস্তি আদতেই খুব সামান্য।

রাষ্ট্র পেয়েছে একটি বিশেষ দিবস, যা আমরা ভুলতে বসেছি। আজ এই মুহূর্তে ১৭ কোটি মানুষকে জিজ্ঞেস করলে ০.০০৯ শতাংশ মানুষও বলতে পারবে না এই দিনটির কথা। কোথাকার কোন ’কাজের ছেমড়ি’ ইয়াসমিনকে মনে রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ কিছু না অবশ্যই। অধিকাংশ সংবাদপত্রেও দিবসটি নিয়ে কোনো সংবাদ নেই, সম্পাদকীয় কলাম বা উপসম্পাদকীয় নেই। দুয়েক্টা পত্রিকা বড়জোর তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পাতায় খুবই অগুরুত্বপূর্ণভাবে দিবসটি নিয়ে দু’চার লাইন লিখেছে।

৩.

অথচ একটি ধর্ষণ ও গণহত্যাকে কেন্দ্র করে এই যে তিনদিনব্যাপী বিশাল গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিলো একটি মফস্বল শহরে, উত্তাল হয়েছিলো সারাদেশ, হাজার হাজার মানুষ নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে পুলিশের উদ্যত রাইফেলের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলো, ৭ জন মানুষ বিসর্জন দিয়েছিলো তাজা প্রাণ… এই দিবসটিকে স্মরণ করে আমরা যদি প্রতিবছর অন্তত একবার করে নিজেরা শপথ নিতে পারতাম যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সচেতনতা গড়ে তুলবো। নিজের সন্তান এবং স্বজনশিশুদেরকে মানবিক করে গড়ে তুলবো। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো… তাহলে হয়তো ধর্ষণ কমানো যেতো।

কিন্তু আমরা তা করিনি, করেছি উল্টোটা, ভুলে গেছি। আর তারে ফলও হয়েছে যথাযথ। এখন আর ইয়াসমিনদেরকে গ্রাম পর্যন্ত যেতে হয় না, সাহেব-প্রভুর বাড়িতেই তারা ধর্ষিত হন, লাশ হয়ে যান। যদি তবু বেঁচে থাকেন, তাহলে একলা একজন কিশোরী ঢাকা থেকে নাইটকোচে দিনাজপুর পর্যন্ত চলে যাবে অক্ষত শরীরে! বাসের সুপারভাইজার হেল্পার ড্রাইভাররা এতোটাই কাপুরুষ?

অতোটুকু প্রয়োজন হয় না, সাকিব আল হাসানের ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চাটা সূর্যমুখী ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে সেখানেও আমরা ধর্ষকরা হাজির হই আমাদের যাবতীয় লোভের নখ আর লালসা নিয়ে।

অথচ ২৫ বছর আগে আমরা ভেবেছিলাম দেশটা পাল্টে যাবে।

যায়নি বলে হতাশ না। অন্তত আজকে থেকেও যদি আমরা সবাই আবার নতুন করে শপথ নিতে পারতাম যে আর কোনো ইয়াসমিন ধর্ষিতা হবে না এই বাংলার মাটিতে… তাহলে আগামী ৫ বছরেই সম্ভব হবে।

শুধু আমরা কিছু মানুষ যদি সংঘবদ্ধ হতে পারি, তাহলেই সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব।

২৫ বছর আগে ইয়াসমিন

comments powered by Disqus