প্রথমা ও গোলাম মুরশিদ প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের বর্জনীয় ইতিহাস

প্রথমা ও গোলাম মুরশিদ প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের বর্জনীয় ইতিহাস

১.
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বড্ড কাড়াকাড়ি। রাজনৈতিক দলগুলো, এমনকী জামায়াত ইসলামীও মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব ইতিহাস বয়ান করে। জনগন তাই বিরক্ত, তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে চায়। এমতাবস্থায় প্রথম আলোর সহযোগি প্রতিষ্ঠান প্রথমা নিয়ে এলো গোলাম মুরশিদের বই “মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, একটি নির্দলীয় ইতিহাস”। সাধু সাধু…

কিন্তু এই বইটি মোটেই সাধু না… অসাধু ইতিহাসে ভরপুর

খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না, কিছু তথ্য দিলেই বইটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। এই বইতে খুব ছোট করে পলাশীর যুদ্ধর কথাও বলা হয়েছে, যেখানে মীরজাফর মীর কাশিমদের নাম অনুপস্থিত। তেমনি বেশ বড় করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করা হয়েছে এই বইতে, যার কোথাও গোলাম আযম, খাজা খয়ের উদ্দিনের নাম গন্ধও নেই! গোলাম আযমবিহীন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্দলীয় বটে!

[গোলাম মুরশিদের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ বইয়ের প্রচ্ছদ]

এই বইটি লিখতে গোলাম মুরশিদ সবচেয়ে বেশি তথ্য সাহায্য নিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারদের লিখিত বিভিন্ন বই থেকে!
সবচেয়ে বেশি ৪৬ বার তিনি উদ্ধৃত করেছেন সিদ্দিক সালিককে!
দ্বিতীয় স্থানে আছেন রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, তাঁর বই থেকে তথ্য নিয়েছেন মাত্র ১৭ বার
আবার তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানও দখল করেছেন পাকিসেনারাই… নিয়াজী এবং রাও ফরমান আলীর বই থেকে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য নিয়েছেন ১২ বার করে!

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা অসংখ্য বই এবং গবেষণাকে তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে পাকিসেনাঅফিসারদের মিথ্যাচারকে। তাই তো লিখেছেন “সিদ্দিক সালিক সেনাবাহিনীর সদস্য হলেও তাঁর খানিকটা ইতিহাস বোধ ছিলো এবং কোথাও কোথাও বেশ নিরপেক্ষ বিবরণ দিয়েছেন”।

যথারীতি তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে। লিখেছেন “তবে মনে হয়, তিরিশ লাখ লোকের জীবনহানি হয়েছিলো বলে যে দাবি করা হয়, তা কিংবদন্তী মাত্র। বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিব রেসকোর্সের ভাষণে তিরিশ লাখের কথা বলেছিলেন। তিনি অনুমান করেই বলে থাকবেন।
তারপরই লিখেছেন “রুডলফ রামেলের অনুমান পাকিস্তান দশ লাখের চেয়েও বেশি লোককে হত্যা করেছিলো। (আর.জে. রামেল ১৯৯৬) যদি তিরিশ লাখ অথবা দশ লাখের বেশির অনুমানে অতিরঞ্জনও থাকে, তা হলে অন্তত তিন/চার লাখ লোক যে নিহত হয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ করার কারণ নেই।“

কিন্তু আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধু আর রামেলের তথ্যকে অনুমান বলে উড়িয়ে দিয়ে তিন চার লাখের হিসাব দিলেও এই তথ্য তিনি কোথায় পেয়েছেন তা উল্লেখ করেননি। কিন্তু তাঁর মতো বড় গবেষক যেহেতু অনেক তথ্য টথ্য নিয়ে এই অনুমান করেছেন, নিশ্চয়ই সেটা খাঁটি বৈকি… এটা যে মুক্তিযুদ্ধের নির্দলীয় ইতিহাস!

গোলাম মুরশিদ লিখেছেন “শরণার্থী শিবিরে যে উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেও যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে উতসাহের অভাব দেখা গিয়েছিলো। কারণ, তাঁরা বেশির ভাগই গিয়েছিলেন সপরিবারে। দেশে ফেরার আগ্রহ তাদেঁর ছিলো তুলনামূলকভাবে কম।“ এবং যথারীতি তিনি লিখেননি এই তথ্য তিনি কোথায় পেয়েছেন?

গোলাম মুরশিদ লিখেছেন “এছাড়া, যারা দেশের ভেতরে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলো, সে রকমের অনেক দালালও নিহত হয়েছিলো। এদের মধ্যে ছিলো রাজাকার, আল শামস, শান্তি কমিটির সদস্য ইত্যাদি। নিহত হয়েছিলো অনেক বিহারীও। এই অবাঙালিদের মধ্যে নিরীহ নির্দোষ ব্যক্তিও ছিলেন অনেকে। নিহত অবাঙালিদেরও সংখা জানা যায় না। বেশ কয়েক হাজার হওয়া সম্ভব।“

গোলাম মুরশিদের ভাষারীতিরও একটা অন্তত নমুনা দেওয়া উচিত। হিন্দু নারীদের ধর্ষণ নিয়ে তিনি লিখেছেন “কুমারী হিন্দু নারীরাই ছিলেন ধর্ষিত হওয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রার্থী

কোলকাতায় সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুজিব বাহিনীর নানাবিধ ষড়যন্ত্রের বিশদ বিবরণ তিনি দিয়েছেন, কিন্তু গোলাম আযমদের ষড়যন্ত্র নিয়ে তিনি টু শব্দটি করেন না… এই হলো প্রথমা এবং গোলাম মুরশিদ প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের নির্দলীয় ইতিহাস!

অনেক গবেষণা করে লেখা এই ইতিহাসগ্রন্থ কোনোভাবেই ইতিহাস গ্রন্থ না, স্রেফ গোলাম মুরশিদের ব্যক্তিগত বয়ান, তারও বেশিরভাগটা তথ্য তিনি নিয়েছেন পাকিসেনাঅফিসারদের কাছ থেকে

[লেখক গবেষক গোলাম মুরশিদ]

২.
গোলাম মুরশিদ এর আগে “রিলাক্ট্যান্ট ডেবিউটান্ট”, মাইকেল জীবনী “আশার ছলনে ভুলি”, “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” “বিলেতে বাঙালিদের ইতিহাস” প্রভৃতি বই লিখে গবেষক হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” প্রথম আলোর বিবেচনায় বর্ষসেরা গ্রন্থ হিসেবে পুরষ্কৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার আগে গবেষক হিসেবে বাংলাদেশে গোলাম মুরশিদকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গ্রহনযোগ্য করা হয়েছে। তারপর নাজেল করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
ইতিহাসবিদ না হয়েও বাংলা সাহিত্যের এই সাবেক অধ্যাপক লিখে ফেলেন মুক্তিযুদ্ধের নির্দলীয় ইতিহাস। পথটা খুব পরিষ্কার।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কী করছিলেন? তিনি কোলকাতায় ছিলেন। অনেক বুদ্ধিজীবী তখন কোলকাতায় বসেও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু গোলাম মুরশিদ যোগ দিয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেখানে তিনি হাসান মুরশিদ ছদ্মনামে লিখতেন। খুব আশ্চর্যের যে, সেই সময় তিনি হাসান মুরশিদ ছদ্মনামে একটি বই লিখেছিলেন “বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি” নামে। তখনকার আওয়ামীলীগের মুখপত্র “জয় বাংলা”র প্রতিটি সংখ্যায় যে বইয়ের ফলাও বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছিলো… আনন্দবাজারে ছাপা হয়েছিলো ধারাবাহিক হিসেবে। “মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, একটি নির্দলীয় ইতিহাস” গ্রন্থের ফ্ল্যাপে গোলাম মুরশিদের পরিচয়ে অন্য বইগুলোর কথা থাকলেও, এই বইটির কথা উল্লেখ করা হয়নি!

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত ছাত্রনেতা, এরশাদের চামচা, বহু নারী কেলেঙ্কারীর হোতা, ডঃ মিলন, মডেল তিন্নি হত্যার পলাতক আসামী গোলাম ফারুক অভির বড় ভাই হলেও গোলাম মুরশিদকে সবাই গবেষক হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু পাকিসেনাঅফিসারদের তথ্যানুযায়ী অনুমান ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের নির্দলীয় ইতিহাস “মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, একটি নির্দলীয় ইতিহাস” লিখে তিনি গোলাম ফারুক অভির বড় ভাইয়ের উপযুক্ত কাজই করলেন!

৩.
গোলাম মুরশিদের সুশীল পরিচয় আর প্রথম আলোর প্রচারণায় মুক্তিযুদ্ধের ছহী ইতিহাস হিসেবে এই বইটি ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়ে যাচ্ছে, সবাই এই বইয়ের লেখা ইতিহাসকেই সত্য বলে জানবে… এভাবেই ধীরে ধীরে আড়ালে হারিয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস। আমরা কি কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবোই শুধু?

[০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus