আমাদের বাবারা ছিলো ভয়ের। সারাদিন যাই করি না করি বাবা বাড়ি ফেরার সময় হলেই সুবোধ বালক। কুপি জ্বালিয়ে পড়ার ভান।
বাবার সঙ্গে কোনো কথাই নেই প্রায়, শুধু খেতে বসে এটা ওটা প্রশ্নের জবাবে যতোটুকু সংক্ষেপে সম্ভব উত্তর দিয়ে পার পাওয়া।
সেই বাবাই কখনো কখনো ভীষণ অন্যরকম হয়ে যেতো। সাদাকালো টিভিতে রাত জেগে বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখার সময় কিংবা সারারাতের মাইজভান্ডারি গানের আসরে কিংবা সকালে গাছ থেকে কাঁঠাল নেমে এলে সবাই মিলে মুড়ি দিয়ে নাশতা খাওয়ার সময় কিংবা নদীতে নাইতে গেলে বা এরকম আরো আরো নানাবিধ সময়ে এই বাবাই হয়ে উঠতেন ভীষণ মিশুক। তবু আমরা জানতাম বাবাকে ভয় পেতে হয়।
ধীরে ধীরে বাবারা বুড়ো হয়ে গেলে আমরাও বড় হয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো, তর্ক আড্ডায় নতুন সমীকরণ হলো সম্পর্কের।
তারপর একদিন যখন মাথার ওপর থেকে বাবাবৃক্ষের ছায়া সরে গেলো, তখন শুরু হলো নতুন ভয়ের… এ ভয় বাবাহীনতার!
সেই ভয়ে এখনো কাতর হই… এই জগৎ সংসার যখন শূন্য হয়ে যায়, অন্ধকার হয়ে যায় তখন মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় বিশাল বাবাবৃক্ষের ছায়াতলে একটু বসতে…
আমরা যারা বাবাকে ভয় পেতে পেতে বড় হয়েছি, তারা কিভাবে কিভাবে যেন নিজেদের সন্তানদেরকে বাবাভয় থেকে মুক্তি দিয়েছি। আমাদের সন্তানেরা নির্দ্বিধায় আমাদের শরীরে লেপ্টে থেকে অথবা আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলতে পারে ‘বাবা আই লাভ ইউ’!
এতোটুকু সাহস আমাদের কখনো ছিলো না। কিন্তু এখন মাঝে মধ্যে মনে হয়, যদি একবার বলতে পারতাম!
এই পরিবর্তিত পৃথিবী, গাঁয়ের সমাজ হারিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে যাওয়ার পৃথিবী, ক্রমশ একাকী বিষাদগ্রস্ত আর হতাশ হয়ে যাওয়া মানুষের পৃথিবীতে আমাদের সন্তানদের কাছে আমরা কি বাবাবৃক্ষ হয়ে উঠতে পারছি? যারা শুধু সন্তানের জন্য নিশ্চিত আবাস, গাড়ি আর ব্যাঙ্কে টাকা রেখেই ভাবতে চাইছি সন্তানের জন্য যথেষ্ট করা হলো… তাদেরকে যদি সন্তানেরা পৃথিবী ধ্বংসের দায় দেয়… কী জবাব দেবো আমরা? শুধু নিজ নিজ সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আমরা কি এই পৃথিবীর সকল সন্তানকে অনিরাপদ করে ফেলিনি?
আমাদের বাবারা হয়তো কল্পনা করতে পারতো সন্তানের ভবিষ্যৎ পৃথিবীটা। কিন্তু এই দ্রুতগতির পৃথিবী আগামী দুই দশকে কোথায় যাবে সেই কল্পনা এখন জুলভার্নও করতে পারবে না… ভীষণ অচেনা এক পৃথিবীর মুখোমুখি হবে আমাদের সন্তানেরা… আমরাই রেখে যাচ্ছি!
ভয় হয়…