শেখ হাসিনা এখন যা-ই করেন বা যা সিদ্ধান্তই নেন, অপছন্দ হলেই আমরা সমস্বরে তুলনা করি শেখ মুজিবের সঙ্গে। আর নির্মমভাবে তাঁকে মনে করিয়ে দেই পিতা এবং পরিবারের ভয়াবহ পরিণতির কথা। নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে বুঝিয়ে দেই ‘আপনিও কিন্তু একই পরিণতির দিকেই যাচ্ছেন!’
‘আমরা’ বলতে শুধু তাঁর বিরোধীরা না, ‘আমরা’ বলতে প্রবল আওয়ামী লীগাররাও!
গত ৪২ বছরে তিনি যে পরিমান মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে, ষড়যন্ত্র আর রক্তাক্ত হামলা মোকাবেলা করে বেঁচে আছেন, অতোটা বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থাকতে হয়নি বাংলাদেশের আর কোনো শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাকে। সারা বিশ্বেও এমনটা বিরল। এখনো প্রতি মুহূর্তে তিনি পাড়ি দিয়ে চলেছেন পুলসেরাত। প্রতি মুহূর্তে, হ্যাঁ প্রতিটি মুহূর্তে।
যখন তিনি বিশ্বের সব মোড়লদের অগ্রাহ্য করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসী কার্যকর করেন দ্বিধাহীনভাবে, তখন কিন্তু আমরা কেউ তাঁকে ৭৫ এর কথা মনে করিয়ে দেই না। কারন তখন আমরা উল্লাসে মাতোয়ারা। কিন্তু তিনি নিজে কি একবার কেঁপে ওঠেন অজানা ভয়ে? সব মোড়লদের বিরাগভাজন হয়ে শেষ সুহৃদ ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও যখন লাখো রোহিঙ্গাকে নির্দ্বিধায় আশ্রয় দেন, তখনো?
মনে হয় না। বারংবার মৃত্যুমুহূর্ত যাঁকে ছুঁয়ে যায়, তাঁর কি আর মৃত্যুভয় থাকে? থাকতে আছে?
আদর্শবাদী রাজনীতির দিন অনেক আগেই ফুরিয়েছে। এখন রাজনীতি করেন ব্যবসায়ী, আমলা, শিক্ষক, ফেসবুকারসহ সব শ্রেণীপেশার মানুষ। রাজনীতির জন্য না, আদর্শের জন্যও না, স্রেফ সুবিধার জন্য।
সেই সুবাদে বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগের জয় জয়কার। হাসিনার জয় জয়কার। এই জয় জয়কার জয় বাংলার না, সুবিধার। এরা জলবৎ তরলং, যে পাত্রে অবস্থান, সেই আকার ধারণ করে। আজ যদি একটা ষড়যন্ত্রও সফল হয়, শেখ হাসিনার কিছু হয় তাহলে এরাই নিশ্চিন্তে ভোল পাল্টে ফেলবে। শোক মিছিল হবে না দেশে, বিজয় মিছিলে যোগ দেবে এরাই। শেখ হাসিনা কি তা জানেন না? সম্ভবত জানেন। ১৫ আগস্টের পর যে এমনকি বিদেশেও তাঁকে আশ্রয় দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন অনেকে, ভুলে তো যাননি!
ফেসবুকে, ইউটিউবে প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার লোক প্রকাশ্যে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকী দেয়। আরেকটা ১৫ আগস্টের স্বপ্নে বিভোর হয়ে খোদাতায়ালার কাছে ফরিয়াদ জানায়!
নির্মম নিষ্ঠুর এই সত্য কথাটা তিনি বোধহয় আমাদের চেয়েও বেশি জানেন। তাঁকে নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যাশা আর অভিযোগ দুই’ই পাহাড়সম। কেন তিনি মৌলবাদকে তোয়াক্কা করেন, কেন এটা বললেন, কেন ওটা করলেন, কেন এটা করলেন না, কেন ওটা করলেন না ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…
এই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তীর ঘাটতিতে তিনদল মানুষ তিনরকম প্রতিক্রিয়া করেন… একদল ভীষণ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েন, বিক্ষোভে ক্ষত বিক্ষত করেন শেখের বেটিকে, বিশ্বাসঘাতক বলেন, মনে করিয়ে দেন ১৫ আগস্টের কথা, গ্রাফিক্সে ডায়লগ দেন ‘বাবা তুমি কানতেছ ক্যান?’। আরেকদল প্রবল বিক্রমে সেই ঘাটতি পুরনে ব্যস্ত হন, যুক্তি তর্কে সমাধান খোঁজেন। আরেকদল খুব নিভৃতে চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকেন, কিন্তু আস্থা হারান না। আমি সেই দলে…
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন দিয়ে তিনি এই আস্থাটুকু অর্জন করেছেন। তাঁর যতটুকু পিছিয়ে যাওয়া আমি দেখি, তৎক্ষণাত খুব ক্ষোভ হলেও পরবর্তীতে সেখানে খুঁজে পাই রাজনৈতিক কৌশল। আমরা বিক্ষোভ করি কেন তিনি প্রথম টার্মেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করলেন না, কেন তিনি প্রথম টার্মেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেন না, কেন এটা করলেন না কেন ওটা করলেন না ইত্যাদি! আর অনেক অনেক পরে গিয়ে টের পাই তিনি ঠিক জানেন কখন কী করতে হয়। করেন…
চারপাশ জুড়ে অসংখ্য আখের গোছানো লোভী মানুষকে নিয়ে, চক্রান্তকারী আর খুনোন্মুখ বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রোশ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে জনসংখ্যা আর দারিদ্রে জর্জরিত একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা কতোটা কঠিন তা আমরা বুঝবো না কখনো। গ্রাফিক্সে আপনাকে ভুল বোঝানোর মিম পোস্ট শেয়ার দিয়ে খুব একচোট আনন্দ লুটে নেবো।
মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে চারপাশের এই প্রবল চাটুকারিতা, ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা সারাদিনব্যাপী সামলে যখন একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান… সতেরো কোটি মানুষের দায়িত্ব আর অভিযোগের বাইরে গিয়ে একটুখানি নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ পান… তখন তাঁর অনুভূতিটা জানতে খুব ইচ্ছে করে।
সম্ভবত বেবী মওদুদের বই পড়েই জেনেছিলাম, শেখ হাসিনা একসময় বেহালা বাজানো শিখেছিলেন। এখন তিনি বেহালা বাজালে সম্রাট নিরোকে আমরা ঘাড় ধরে বাংলাদেশে নিয়ে আসবো নিশ্চিত। তবু আমার সাধ, একদিন তাঁর বেহালা বাদন শুনবো! যদিও জানি, সে সুযোগ আমার হবে না কখনো। আমি কেবল দূর থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার বার্তাটাই জানাই, সেটাও তাঁর চোখে পড়বে না কখনো জানি, তবু জানাই।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়, ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়
জন্মদিনে নবজন্ম হোক
……………………………………………………
নজরুল সৈয়দ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০