মার্কার গল্প

মার্কার গল্প

পর্ব ১: নৌকা কিভাবে আওয়ামী লীগের হলো

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন উপলক্ষ্যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। সে লক্ষ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে তখনকার আওয়ামী মুসলিম লীগ আর শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি মিলে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সঙ্গে যোগ দেয় পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল আর পাকিস্তান খেলাফত পার্টি। শরীক হিসেবে সঙ্গে থাকে আতাহার আলীর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম পার্টি আর হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে গণতন্ত্রী দল।

বৃটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলার নির্বাচনে এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক ছিলো লাঙ্গল। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়, যেখানে ফজলুল হক সিনিয়র নেতা ছিলেন। তাছাড়া অন্য দলগুলোর তখনো কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার অভিজ্ঞতা ছিলো না। ফলে কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গলকেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক করার আবেদন জানানো হয়। কিন্তু ঠিক একই যুক্তিতে কমিশন লাঙ্গলকে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তখন প্রয়োজন পড়ে নতুন একটি নির্বাচনী প্রতীকের।

যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিলো মূলত বর্তমান বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ভোট মাথায় রেখে। তাই পূর্ব পাকিস্তানের আমজনতার কাছে আপন মনে হবে এরকম একটা নির্বাচনী প্রতীক খোঁজা হয়। নদীমাতৃক বাংলায় তখনো কৃষি, ব্যাবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, সমাজ, জীবন সবকিছুই ছিলো নৌকা নির্ভর। সারাদেশে ভেসে বেড়াতো বর্ণিল পালতোলা নৌকারা। আর মাঝিরা গাইতো ভাটিয়ালি গান। ফলে খুব অনায়াসেই আওয়ামী মুসলিম লীগের নির্বাচনী প্রতীক হয়ে ওঠে নৌকা। নির্বাচন কমিশনও আপত্তি করে না।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রথমবারের মতো নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। ৮ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৩৭ টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ২২৮ টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। যার মধ্যে ১৪৩টিই পায় আওয়ামী মুসলিম লীগ। ৪৮টি পায় কৃষক প্রজা পার্টি। নেজামী ইসলাম পায় ২২টি, গণতন্ত্রী পার্টি পায় ১৩টি আর খেলাফত রাব্বানী পায় ২টি। নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠন করে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। আর যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় শরীক দল হিসেবে নৌকা প্রতীক আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। কৃষক প্রজা পার্টি ফিরে যায় নিজেদের পুরনো লাঙ্গল প্রতীকে।

এরপর আসে ৭০ এর নির্বাচন। সে নির্বাচনে নৌকা তথা আওয়ামী লীগের (ততোদিনে খসে পড়েছে ’মুসলিম’ শব্দটি) ভূমিধ্বস বিজয়ের কথা সবাই জানেন। সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই নৌকার তথা আওয়ামী লীগের জয় জয়কার। আজ পর্যন্ত।

পর্ব ২: লাঙ্গল কিভাবে জাতীয় পার্টির হলো

এর মধ্যে শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মৃত্যু হয়। কৃষক প্রজা পার্টিও কমজোর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের তরুণ নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম এবং চরিত্র পাল্টে, সাম্প্রদায়িকতা ঝেড়ে ’আওয়ামী লীগ’ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই দল ছাড়তে থাকেন। আতাউর রহমান খানও তৈরি করেন আলাদা রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় লীগ’। আর সুযোগ বুঝে কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গলকে নিজের করে নেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় লীগ লাঙ্গল প্রতীকেই নির্বাচন করেছিলো, যদিও কোনো আসন পায়নি। তবে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান ঢাকা ১৯ আসন থেকে বিজয়ী হন।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করলে আতাউর রহমান খান জাতীয় লীগ ভেঙ্গে বাকশালে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। লাঙ্গল আবার দলহীন হয়ে পড়ে। ৭৫ এর আগষ্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আতাউর রহমান খান বাকশাল ত্যাগ করে আবার তার জাতীয় লীগকে পুনর্গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে ঢাকা ২১ আসন থেকে নির্বাচিতও হন। ১৯৮৩-৮৪ সালে ৭ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক দল হিসেবে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করে আতাউর রহমানের নেতৃত্বাধীন লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় লীগ।

কিন্তু তারপরেই তিনি অকস্মাৎ কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে বিপ্লব জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সরাসরি এরশাদ সরকারের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ তিনি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নিজের দলের নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গল তুলে দেন এরশাদের কোলে। এরশাদের রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’ নামটাও আতাউর রহমান খানের ‘জাতীয় লীগ’ থেকেই নেওয়া। অবশ্য খান সাহেবের সাধের এই প্রধানমন্ত্রীত্ব দুই বছরও টেকে নাই। ৮৫ সালের ১লা জানুয়ারিতেই খারিজ হয়ে যায়। মাঝখানে দল আর প্রতীক হারায়ে এককালের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান হয়ে পড়েন নিঃস্ব।

পর্ব ৩: ধানের শীষ কিভাবে বিএনপির হলো

এবার আসা যাক ধানের শীষের গল্পে। মজলুম জননেতা কিংবা রেড মওলানা হিসেবে খ্যাত মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করে গঠন করেন বামপন্থী রাজনৈতিক দল ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’, সংক্ষেপে ‘ন্যাপ’। ন্যাপ গঠিত হয় ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই। কিন্তু তখন পাকিস্তানে কোনো নির্বাচন ছিলো না, ছিলো সামরিক শাসন। ফলে ন্যাপের কোনো নির্বাচনী প্রতীকেরও প্রয়োজন ছিলো না শুরুতে। প্রতীক পাওয়ার আগেই চীন আর সোভিয়েত দুই পন্থায় ন্যাপ ভাগ হয়ে যায়। সোভিয়েতপন্থী অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ন্যাপের একাংশের নেতৃত্বে থাকেন যা ’ন্যাপ (মোজাফফর)’ নামে পরিচিতি পায়। আর ভাসানীর নেতৃত্বাধীন অংশ ‘ন্যাপ (ভাসানী)’ হিসেবে পরিচিতি পায়, তারা চীনপন্থী।

এর মধ্যে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা আসে। সেই নির্বাচনে ভাসানীর নেতৃত্বে চীনপন্থী ন্যাপ অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। দলীয় প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ পায় ধানের শীষ। আর মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েতপন্থী ন্যাপ বরাদ্দ পায় কুঁড়েঘর প্রতীক।

কিন্তু সেবছর ১২ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হলে এবং তাতে পাকিস্তান সরকারের বিন্দুমাত্র সহযোগিতা না পাওয়ায় প্রতিবাদ হিসেবে ভাসানী ৭০ এর নির্বাচন বর্জন করেন। ফলে ধানের শীষ প্রতীক আর ব্যাবহৃত হয়নি। এর পর তো মুক্তিযুদ্ধ হলো, স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্ত হলো। ৭৩ এর নির্বাচনে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চীনপন্থী ন্যাপ অংশ নিয়ে সারাদেশে মাত্র ১০ লাখ ভোট পায়, কোনো আসন পায়নি।

১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নৃশংসভাবে হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে। কালক্রমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের অন্যতম সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে তৎকালীন পুতুল রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমকে হটিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন জিয়া।

ইতোমধ্যে মাওলানা ভাসানীর মৃত্যু হলে ন্যাপ ভাসানী বিপর্যস্ত হয়ে যায়। আর ঠিক তখনই জিয়াউর রহমানেরও প্রয়োজন ছিলো একটি রাজনৈতিক দলের। ভাসানীর সৈনিক মশিউর রহমান যাদু মিয়া দলবলসহ জিয়ার হাতে নিজেকে সমর্পন করেন। একই সময় জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে পাকিস্তানপন্থী শাহ্ আজীজুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগও যোগ দেয়। দুই দল মিলিয়ে জিয়া গঠন করেন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’, সংক্ষেপে ‘বিএনপি’। আর বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে দখল করেন ভাসানী ন্যাপের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ!

একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতীক পরগাছাদের কাছ থেকেই পাওয়া। অনেক সূধীজন নিশ্চয়ই এখানে জামায়াত ইসলামীর প্রসঙ্গ টানতে চেষ্টা করবেন। সম্মানিত তাঁদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে জামায়াত ইসলামী একটি যুদ্ধাপরাধী দল।

comments powered by Disqus