”পৃথিবী থেকে শিশিরের মত ঝরে যাবে বছর। আবার শিশিরের বিন্দু মুক্তো হয়ে জ্বলজ্বল করবে আমার পৃথিবীতে। সেই মুক্তোর পরশ যখন আমার হাতে অঞ্জলি ভরে নেবো, মনে হবে মিতাকে। সেখানে সে আপন ভাস্বরে দীপান্বিতা।”
আলট্রামেরীন, মুর্তজা বশীর
প্রথম দেখায় জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘আপনি কেন নিয়মিত লেখেন না?’ মুর্তজা বশীর অবাক হয়েছিলেন।
তাঁর সঙ্গে সবাই সাধারণত চিত্রকলা নিয়েই কথা বলে। সাহিত্যকর্মের খোঁজ খুব বেশি লোকে রাখে না, পড়ে তারও কম। আমি তাঁর সবগুলো প্রকাশিত বই পড়েছি শুনে একটু বেশিই অবাক হয়েছিলেন।
তরল গড়াতে গড়াতে ভোর হয়ে এসেছিলো। পাশের যমুনা নদীর জলে চাঁদের আলো জ্বলছিলো। আর তাকিয়ায় বসা মুর্তজা বশীর বলে চলছিলেন জীবনের একের পর এক গল্প। আর তাঁর সামনে বসে আমরা কয়েকজন মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। এতো রসিয়ে রসিয়ে গল্প করেন তিনি, অন্য সবাইকে কেবল শ্রোতা হয়েই থাকতে হয়। আর জীবনের এতো দারুণ সব অভিজ্ঞতা! যেন অসংখ্য দুর্ধর্ষ মারমারকাটকাট চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য এক জীবনের ভেতরে ঠেঁসে দিয়েছে কোনো চিত্রনাট্যকার। কিংবা মুর্তজা বশীরই বিশাল এক ক্যানভাসে হাজার হাজার রঙের দ্যোতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন!
বাবা যদি হন ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তাহলে জন্ম থেকেই খ্যাতি আর জ্ঞানলোকের অংশ হতে হয়। মুর্তজা বশীরেরও কমতি হয়নি। কিন্তু সুশীল সমাজের অংশ হয়ে নিশ্চিত জীবন চাননি বোধহয় তিনি।
বাংলাদেশে চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হলেন। যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির ডাকে পড়ালেখা আর রঙতুলি ফেলে ছুটে গেলেন গারো পাহাড়ে, সেখানে তখন বিদ্রোহ চলছে। গারো হাজং বিদ্রোহ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ হয়ে মাদ্রাজের তেলেঙ্গানায়… বিপ্লব যেখানে, মুর্তজা বশীর সেখানে। গ্রেপ্তার হলেন। বিদ্রোহ আর মানুষের ছবি আঁকতে থাকলেন পেন্সিলের দাগে। কৃষকনেতা বারী মিয়া, খেতমজুর নেতা মনু মিয়া, আলী আকসাররা হয়ে উঠলো মুর্তজা বশীরের আঁকার প্রতিকৃতি।
একেবারে স্কুল জীবন থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। ৫২ সালের আমতলার জনসভা, তৎপরবর্তী মিছিল আর পরদিন শহীদের জানাজা… সবটাতেই মুর্তজা বশীর হাজির।
ফ্লোরেন্সে পড়ার সময় সেখানে গড়ে তুললেন আদিমতার আন্দোলন।
কী বৈচিত্রময় জীবন তাঁর।
যখন জেনেছিলাম ৬৩ সালের উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়াঁ’র কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন মুর্তজা বশীর, চমকে গিয়েছিলাম। ৬৪ সালের ‘নদী ও নারী’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তাঁর করা। এই চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশক আর প্রধান সহকারী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন মুর্তজা বশীর। পরের বছর উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কাহু’র ছিলেন শিল্প নির্দেশক। চলচ্চিত্রের প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁর ছিলো, তা লেখাই বাহুল্য। কিন্তু নিজে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। এমনকি নিজের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন’ এর চিত্রনাট্যও নিজে করেননি, করেছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তা নিয়ে অবশ্য কিছু অতৃপ্তিও ছিলো বশীরের, জানিয়েছিলেন।
কেন তিনি পরবর্তীতে আর চলচ্চিত্রের সঙ্গে থাকলেন না? ভালো লাগছিলো না? আমরা দেখি একসময় সাহিত্য থেকেও নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন মুর্তজা বশীর। মিতাকে নিয়ে আর লিখলেন না!
মুর্তজা বশীরের গল্প উপন্যাস সবকিছুর নায়িকা ‘মিতা’। তাঁর মানসপ্রতীমা যেন। মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে কিংবা অমিত্রাক্ষর!
”কিংবা বাসে করে চলে যাবো কোন ছুটির দিনে সমুদ্রের ধারে। সাদা শাড়ি, চুলের প্রান্তে সাদা ফিতের প্রজাপতি আর সাদা ব্লাউজ দেখতে দেখতে আমার মনে হবে ও যেন সমুদ্রের ফেনা। দু’হাতের অঞ্জলিতে ফেনার রাশি নেয়ার মত ওকে কোলে তুলে নেবো, বসবো কোন বালির টিলার পাশে। পায়ের কাছে থাকা গঙ্গালতার ফুল ছিঁড়ে নিয়ে বসবে মিতা। আর আমি তুলে নেবো স্কেচ খাতা, রং আর তুলি। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে হৃদয়ের স্তেপন্মদন শুনতে পাবো।আমার ছবি আঁকা আর হবে না।
না, হবে না”
[আলট্রামেরীন, মুর্তজা বশীর]
নিয়মিত আর না লিখলেও, চলচ্চিত্র না করলেও বশীরের গদ্য মুগ্ধ করেছিলো। নির্মেদ বাংলা ভাষা। টানটান, ঝরঝরে। ছোটো ছোটো বাক্য। অনুভূতি আর কল্পনার খুব দৌড়। টেনে হিঁচড়ে ধ্রুপদী সাহিত্য বানানোর কোনো চেষ্টা ছিলো না তাতে।
চারুকলায় তাঁর অবদান অস্বীকার করার কিছু নেই, কিন্তু আমার সত্যিই মনে হয় মুর্তজা বশীর যদি সাহিত্যেও থাকতেন আরো কিছুটা, সমৃদ্ধ হতো। তাঁর সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র একটাও দেখার সুযোগ হয়নি, তাই জানাও হয়নি সে সম্পর্কে। কিন্তু সাহিত্যের বেলায় আমি নির্দ্বিধা।
এই স্বজন হারানোর বছরের আধেকটা বাকী রেখেই অসংখ্যজন ছাড়িয়ে গেলেন পৃথিবীর মায়া। মুর্তজা বশীরও যোগ দিলেন সে দলে। করোনা কেড়ে নিলো তাঁর প্রাণ।
ক্ষতিটা অফুরাণ!
এই ছবিটা মুর্তজা বশীর এঁকেছিলেন যমুনা আর্ট ক্যাম্পে। পটচিত্রের রঙে এঁকেছিলেন এই নারী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো এই চিত্রকর্মটা আঁকার পুরোটা সময় সামনে বসে দেখার! এই স্মৃতিটা অবিস্মরণীয় হয়ে রইলো।