সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ পড়াটা কেন জরুরী

সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ পড়াটা কেন জরুরী

১.
আমি যে ইতিহাস নির্ভর উপন্যাসের ঘোরতর বিরোধী লোক, তা অন্তর্জালের আনাচে কানাচে একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আমি বরাবর এই পন্থার বিরোধীতা করে আসছি। কারন ইতিহাস নির্ভর গল্প বলার সুবিধা আর স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অনেক অসত্য তথ্য মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যেখানে এমনিতেই ছড়িয়ে আছে প্রচুর বিভ্রান্তি। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতাবিরোধীরা অসত্য ইতিহাস লোকের মগজে ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়ানোর জন্য গল্প উপন্যাস খুবই বিপজ্জনক পন্থা। মেহেরজান তো এখনো দগদগে স্মৃতি। তাই এই ধারাটা জনপ্রিয় হোক চাই না।

কিন্তু এতো বলেও কাউকে থামানো যায় না, সবাই শুধু উপন্যাস পড়েই ইতিহাস জানতে চায়। তাও বেশি না, একটা বই পড়েই জানতে চায় সবটা। ‘ভাইয়া, একটা বইয়ের নাম বলেন না, যা পড়লে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি একটা ঠিকঠাক ধারণা পাওয়া যাবে’। এতদিন খুব মুশকিল ছিলো এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। গতবছর থেকে ব্যাপারটা সোজা হয়ে গেছে। খুব ভাব নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে এখন বলি ‘শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানলে তো হবে না, পরের পল্টিবাজীর ইতিহাসগুলোও জানতে হবে’। প্রশ্নকর্তা বা কর্তিনী তখন আরো অসহায় হয়ে বলে ‘এতোকিছু কিভাবে জানতে পারবো ভাইয়া? এতো বই কবে পড়বো?’ তখন আমি আরো বেশি জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলি ‘একটা বই পড়লেই মোটামুটি একটা ঠিকঠাক ধারণা পাওয়া যাইতে পারে, পইড়া দেখতে পারেন’। তখন প্রশ্নকর্তা বা কর্তিনী খুব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কী বই ভাইয়া? কী বই? কার লেখা বই ভাইয়া? কার লেখা বই?’ আমি তখন ততোধিক ভাব নিয়ে বলি ‘খালি তো হুমায়ুন আহমেদ আনিসুল হকদের বই পড়েন, তাইলে হবে? সুহান রিজওয়ানের সাক্ষী ছিলো শিরোস্ত্রাণ বইটা পইড়া দেইখেন, বিফলে মূল্য ফেরত’।
এক বছর পার হয়ে গেছে, এখনতক কাউকে মূল্য ফেরত দিতে হয় নাই। আশাকরী কষ্মিনকালেও দিতে হবে না। অতএব হে মহামান্য পাঠক, মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী ইতিহাসের মূল ধারাটা যদি ঠিকঠাক জানতে চান, তাইলে আর দেরি না করে সুহানের লেখা সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ বইটা পড়ে ফেলেন। আবারো বলি, বিফলে মূল্য ফেরত চোখ টিপি

২.
বইটি নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে কথাটা বলা যায় তা হলো এ একটা দারুণ সাহসী কাজ হয়েছে। অনেকগুলো বছর ধরেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু যতোই জানি, ততোই যেন অজানা থেকে যায়। যুদ্ধ, যুদ্ধের রাজনীতি, পক্ষ প্রতিপক্ষ… জানতে জানতে হয়রান হয়ে যাই। এ যেন এক বিশাল ক্যানভাস, যার প্রতিটি ক্ষুদ্র ফোঁটার পেছনে রয়েছে আরো বিশাল সব ক্যানভাস। এই বিশাল প্রেক্ষাপট নিয়ে উপন্যাস লেখা চাট্টি চাট্টি আট্টি কিংবা আট্টি আট্টি ষোলটি কথাও না, তারচেয়ে বেশি কিছু। সুহান সেই বিশাল কাজটা করে ফেলেছে। মনগড়া কিছুও লেখেনি, একেবারে বইপত্র পড়ে ঠিক ইতিহাসটুকু জেনে সেগুলোকে সাজিয়েছে উপন্যাসের আদলে। এরকম একটা উপন্যাস লেখা তো দূরের কথা, চিন্তা করতেও বিশাল কলিজা লাগে। সুহান চিন্তা করে, কয়েক বছর একটানা খাটা খাটুনি করে, নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে, পড়াশোনা করে উপন্যাসটা লিখে প্রকাশও করে ফেলেছে। তাঁকে স্যালুট জানানো ছাড়া উপায় নেই।

[লেখক সুহান রিজওয়ান]

৩.
এটুকু জোর দিয়ে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সহজ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য এরকম একটি বইয়ের খুব দরকার ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আরো অনেক কিছু করার আছে, যে পরিমান অপপ্রচার চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে এখনো, তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে অনেক অনেক বেশি। সেই লড়াইয়ে সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সংযোজন। পরবর্তী সুহানেরা এখান থেকে নতুন করে শুরু করতে পারবে।

৪.
এতক্ষণ ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলে এলেও সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ মূলত তাজউদ্দীন আহমেদের জীবনী। কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত যে তাজউদ্দীন আহমেদ, তাঁকে আঁকতে গেলে আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ইতিহাসের পুরোটাই আঁকতে হয়। কারন তাজউদ্দীন আহমেদ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সমান্তরাল। সুহান তাই যতোই তাজউদ্দীন আহমেদের জীবনী লেখার চেষ্টা করুক, তা হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ের ইতিহাস।

৫.
বইয়ের নাম: সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ
লেখক: সুহান রিজওয়ান
বর্তমান প্রকাশক: ঐতিহ্য
একুশে বইমেলার স্টল নং: ২৬০
মূল্য: লেখা আছে ৭০০ টাকা, মেলার ছাড়ের পর ৫২৫ টাকা
প্রচ্ছদ: স্যাম

[২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus