একজন মাত্র সন্তান আমার। মোটে চার মাস তার বয়েস। হুটহাট কাঁদে, হাসে। কথা বলতে পারে না একটুও, শুধু ইতং বিতং শব্দ করে। কিচ্ছু বুঝি না। তার মধ্যেই আপ্রাণে তার মা খুঁজে বের করে কোন শব্দটা মায়ের কাছাকাছি হলো, কোনটা হলো বাবার কাছাকাছি।
আমাদের সংসারে আমরা তিনজনই কেবল, তাই তাকে নিয়েই আমাদের খেলা, সারাক্ষণ। সে যখন এত্ত সুন্দর করে হাসে, তখন মনে হয় কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলি আদরে। সে যখন কাঁদে, তখন মনে হয় কোলের ভেতর কোলে একেবারে হৃদয়ের অন্দরে রেখে আদর করি, কান্না থামাই। অনেক কাজের ভীড়ে যখন অনেক ক্লান্ত, তখন তার হাসন্ত বা কাদন্ত বা ঘুমন্ত মুখটা দেখে একটুখানি ছুঁয়ে আবার নবপ্রাণিত হই। তার চাইতে প্রিয় আমার আর কেউ নাই। এই পৃথিবীতে সেই যে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নিজস্ব। অন্যের কোনোকিছু কখনো কি এতো আপন আর এতো ভালোবাসার ধন হতে পারে?
এক বন্ধু একবার খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলো। জীবনের আর কোনো মূল্য ছিলো না তার কাছে। ফোনে কেবলি বলছিলো সে মরে যাবে। মাঝরাতে গিয়ে তার হাত ধরেছিলাম কেবল। হাত ধরে বসেছিলাম। তার বিপদে কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু একটুখানি স্পর্শ করেছিলাম মাত্র। সে মরেনি, বেঁচে আছে আজো। বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে।
যাকে ধরা যায় না, ছোঁওয়া যায় না, তাকে যে ভালোবাসাও যায় না।
আরেক বন্ধু ছিলো, কোন কথায় সে রাগ করবে আর কোনটাতে করবে না তা আমি জীবনে কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি, তার সাথে বা তাকে নিয়ে বন্ধুমহলে কথা বলতেও আমার খুব ভয় হতো। কি জানি, কখন রেগে যায়! সেই ভয়ে কোনোদিন তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হলো না, বন্ধুত্ব হলো না।
অথচ আমার প্রিয় যে কয়টা বাল্যবন্ধু, তাদের প্রত্যেকের সাথে আমার হাজারবার ঝগড়া হয়েছে, মারামারি হয়েছে। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটাকে মনে আছে, রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছিলাম একদিন। এখন ওই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওর কিছু হলে কসম আমি সবার আগে ছুটে যাবো।
স্পর্শটা আমার কাছে খুব ইম্পর্টেন্ট। স্পর্শকাতরতায় আমার খুব ভয়, ভয়ের সমান দূরত্ব।
ইদানীং আমার ধর্ম নিয়ে কিছু বলতে বা করতে গেলেই ভয় হয় খুব। এত্ত বেশি স্পর্শকাতর হয়ে গেছে, ধরা ছোঁওয়ার অনেক বাইরে চলে গেছে যেন। মনে হয় কেউ যেন বলছে ‘বামন হয়ে চান্দের পানে হাত বাড়াইও না।’
একটা গান খুব মনে পড়ছে, ‘প্রেম কি কাচের বাসন, ঠুনকো সে কি এমন, ভেঙ্গে যায় ছুঁলে পাড়া পড়শী, প্রেম কি কমে বাড়ে নিন্দে হলে কম বেশি?’
[লেখাটি ২১সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত: http://www.sachalayatan.com/nazrul_islam/8800]