বই পড়ার খুব ভীষণ একটা মজা আছে।
ছোটোবেলায় কিন্ডারগার্টেন ইশকুলে পড়ি তখন। ক্লাশ থ্রিতে পড়ার সময় থেকেই কিভাবে যেন গল্পের বই পড়াটা নেশা হয়ে যায়। আর অবাক হয়ে খেয়াল করি যে আমার যারা বন্ধু, তারা কেবল তাদের বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু, আত্মীয়, শিক্খস, ফেরিওয়ালাকেই চেনে। কিন্তু আমি এদের বাইরেও অনেকজনকে চিনি। আর আমার সেই চেনা লোকগুলো মোটেও চারপাশের উপদেশদায়ক বুড়ো লোকগুলো না। এক্সাইটিং সব ক্যারেক্টার… যারা সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁইয়ে জাগিয়ে তুলতে পারে অপরূপা রাজকন্যাকে। যারা ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে আসতে পারে গোটা পৃথিবী, পাতালপুরীরক। অমিতশক্তির রাক্ষসদের মেরে হাড় গুঁড়ো করে দিতে পারে। যাদের কথায় ওঠে বসে চন্দ্র সূর্য বনস্পতি।
খুব অবাক হয়ে দেখলাম আমি এদের সব্বাইকে চিনি। সকলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই দেশ দেশান্তর।
[২০১০ সালে বাংলা একাডেমির দেওয়া ‘পলান সরকার পুরষ্কার’ গ্রহণ করছি আমি]
আর খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম বন্ধুদের মাঝে আমি হিরো হয়ে গেছি অজান্তেই। আমার মুখনিসৃত এইসব গল্প তারা গোগ্রাসে গেলে। প্রতিদিনই নতুন নতুন গল্প শোনার আব্দার। আর আমি হয়ে যাই বন্ধুদের মধ্যমনি। নিজেকে রাজ্জাক রাজ্জাক লাগতে শুরু করলো।
এই হিরোইজমের নেশায় পাগলের মতো বই পড়া শুরু। প্রতিদিন যে আমাকে নতুন নতুন গল্পের যোগান দিতে হবে। নাহলে যে আমার শিরোপা হাতছাড়া হয়ে যাবে। বই পড়ো, বই পড়ো নজরুল, বই তোমাকে পড়তেই হবে, অনেক বই পড়তে হবে।
পড়ার প্রয়োজনটা আরো বেশি দেখা দিলো ইশকুলেরই এক তরুণী শিক্ষিকার কারনে। বালক বয়সের যা দোষ, একটু কম বয়সী সুন্দরী টিচার দেখলেই প্রেমে পড়ে যাওয়া রোগ। তার কাছ থেকেই বেশি বেশি বকা খেতে ইচ্ছে করে। ক্লাশে আউট বই পড়ার অপরাধে দিলেন বকা, কিন্তু ক্লাশ শেষে সেই বইটাই ধার নিলেন পড়তে, দিলেন পরদিন। জিজ্ঞেস করলেন আর বই আছে কি না এরকম।
মনে আছে পরদিন ইশকুলে হাজির হয়েছিলাম গোটা পাঁচেক বই নিয়ে! তিনি সেথা থেকে তুলে নিলেন একখানা বই, আহা… মরি মরি।
তারপর প্রতিদিন, শুধু তার জন্য বই জোগাড় করতেই আমার দিন গুজরান। একদিন তিনি বই নিলেন না আমার কাছ থেকে, বললেন এগুলো তার পড়া। মেজাজ গেলো খিঁচড়ে, জেদ গেলো বেড়ে। কিন্তু যতোই বই হাজির করি, তিনি আর নেন না! মহা মুশকিল!
বুঝলাম এসব তার জন্য একটু শিশুতোষ হয়ে গেছে। পড়া শুরু হলো বড়দের বই। তার উছিলাতেই, অথবা নিজেরও শিশু বইয়ের জোগান কমে আসছিলো বলে পড়া শুরু হলো বড়দের বই।
কৈশোরে সবাই যখন ইশকুল বেঞ্চে নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই খোদাই করতে পারতো না, তখন আমি আস্ত প্রেমের কবিতা বোর্ডে লিখে দিতে পারতাম! বই না পড়লে এগুলো হতো?
ইশকুলে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করা হবে। সদা ভ্রু কুঁচকানো হেডস্যার আমাকেই ডেকে পাঠান। দশম শ্রেণীর ছাত্রদের বিদায় সম্বর্ধনা? বই উপহার দিতে হবে সবাইকে? বই বাছাই আর কেনার দায়িত্বও আমার। বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় সেরা ছাত্রদের জন্য বই কেনার দায়িত্বও আমার। ইশকুলে গণ্যমান্য অতিথি আসবেন? মানপত্র লিখতে হবে? ডাকো নজরুলকে। ইশকুলভর্তি ছেলেমেয়েদের অবাক চোখের সামনে দিয়ে আমি স্যারদের সাথে সাথে সব কাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠি!
অবশ্য পাঠ্যবইয়ের নিচে গল্পের বই আবিষ্কার করে বা অ্যাসেম্বলিতে প্যান্টের পকেটে মাসুদ রানাসমেত ধরা খেয়ে অনেক অপমান আর কানমলাও সইতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও হিরো হওয়াটা ঠেকাতে পারেনি সেই ভিলেন স্যারগুলো।
[অতিথি ও অন্যান্য ক্যাটাগরিতে পুরষ্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে]
তখন যখন স্যাটেলাইট মোবাইল ইন্টারনেট দেশে নাই, তখন মেট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাসের পরে ছিলো বই পড়ার সিজন। যে জীবনে গল্পের বই পড়ে নাই সেও তখন দুচারটা বই পড়তো। তিন মাস সময় যে কাটাতে হবে। এখনকার মতো ব্যস্ত জীবন তো তখনো শুরু হয়নি মানুষের।
এই সময় পুরো মহল্লা জুড়ে আমার কদর বাড়তো। কারন মহল্লায় আমার বইয়ের কালেকশন ছিলো সবচেয়ে ভালো। সিনিয়র ভাইবোনেরা বই ধার নিতো। আমারই ক্লাশের এক সুন্দরীর বড়ভাই মেট্রিক পরীক্ষার পরে আমার বইয়ের নিয়মিত ধারক হলো, আমি দেখলাম এই মওকা। আমি তাকে যতো বই ধার দেই, সেই বইতেই একটা করে সুইট রোমান্টিক কবিতার দুচার চরণ দিয়ে দেই, কারন গোপন সূত্র মারফত খবর পাই… ছোটবোনও সেই বই পড়ে!
:)