অ্যাকশন রিপ্লে!

অ্যাকশন রিপ্লে!

রাত তখন মাঝরাত ছাড়িয়ে, হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবটা সংসদ ভবনের উল্টোদিকে একটু থামলো, ড্রাইভার পেছনে হাত বাড়িয়ে জানালার কাঁচটা ভালো করে আটকে দিলো। তখন একটা শব্দ হলো ঠুশ, কিন্তু ট্যাক্সিস্থ চার তরুণ আড্ডায় এতোটাই মজে ছিলো যে শব্দটা আলাদা কোনো অনুরণন তুললো না তাদের মনে। মাঝরাত পেরুনো নগরে ট্যাক্সি চললো দ্রুতবেগে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ঢোকার মুখে আরেকবার হলো শব্দটা, শুনলেও আলাদা করে খেয়াল করলো না চার তরুণ।

২৭ নম্বর রাস্তা ছেড়ে ট্যাক্সি যখন লালমাটিয়ার রাস্তায়, ঠিক তখন একটি পাজেরো জিপ ওভারটেক করে পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেলো, আর তা থেকে নেমে এলো দুজন, তারাও তরুণ, হাতে অস্ত্র! ইতোমধ্যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা টয়োটা। ট্যাক্সির চলার পথ নেই, ঘিরে ধরেছে আততায়ী!

এতটাই আকষ্মিক, কী করবে বুঝতে পারছিলো না চার তরুণ। একজন চাপা স্বরে ড্রাইভারকে কী যেন বললো আর ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। একদমই জায়গা ছিলো না যাওয়ার, কিন্তু প্রাণের তাগিদ বোধহয় ড্রাইভারেরও আছে। গ্রাফিক্স আর্ট ইন্সটিটিউটের সামনের রাস্তাটা যারা দেখেছেন তারা জানেন, রাস্তার পাশে একটু ঘাস টাস আছে। ড্রাইভার ঘাস মারিয়ে ছুটলো। সত্যি বলতে এটুকু সরু জায়গা দিয়ে গাড়ি চালানোর কথা সিনেমার স্ট্যান্টম্যানও ভাববে কী না সন্দেহ। কিন্তু জীবন বাজী রাখা ড্রাইভার পার হয়ে গেলো!

সোজা গেলে নূরজাহান রোড বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু ফাঁকা রাস্তায় পাজেরোর সঙ্গে পারা যাবে না। তাই গাড়ি ঢুকলো লালমাটিয়ার গলিতে। চার তরুণের একজন জন্ম থেকে লালমাটিয়াতেই জ্বলছে, পুরো অঞ্চলটাই তার খেলার মাঠ, তাই সব চেনে হাতের তালুর মতো। তারই নির্দেশনায় ট্যাক্সি ছুটলো। ততক্ষণে সবাই মাথা নিচু করে ফেলেছে, ড্রাইভার অন্ধের মতো ছুটছে।

ক্যাব চলছে, পেছনে খানিকটা দূরত্বে চলছে পাজেরো আর টয়োটা। স্পিড মারাত্মক। ভাগ্যিস রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা ছিলো! মাঝে মধ্যে গুলি হচ্ছে। যেন হলিউডি কোনো এ্যাকশন ফিল্মের চিত্রায়ণ! কতক্ষণ চললো এই শ্বাসরুদ্ধকরতা? কেউ কি তখন ঘড়ি দেখে? দেখে না। অনেক বছর পরে মনে হয় অনন্তকাল! তবে পুরো লালমাটিয়ার প্রতিটি অলিতে গলিতে একাধিকবার করে যেতে হয়েছে। প্রধান সড়কে থাকলে নির্ঘাত ধরা পড়তো, কিন্তু অলিগলিতে ক্যাবের সঙ্গে পাজেরো ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না। দূরত্বটা তাই একসময় বেড়ে যায়।

তাদেরই আরেক বন্ধু তখন লালমাটিয়াতেই থাকে একটা সুবিশাল এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে। সেই বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। মাঝরাত পেরিয়ে তখন রাত দুটো। এইসময় এসব বাড়িতে বিনা অনুমতিতে হুট করে চার তরুণের প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু ইন্টারকমে ফোন করে বন্ধুর অনুমতি নিতে নিতে তো মরে যাবে এরা!
চারজনেরই ছিলো এই বাড়িতে ব্যাপক আড্ডা। ফলে সিকিউরিটি তাদের চিনতো। তাই ঢুকতে দিলো গাড়িসমেত। রক্ষে পেলো প্রাণ! গাড়িটা ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কিছু মুহূর্ত পরেই পাজেরো আর টয়োটা পেরিয়ে গেলো সামনের রাস্তা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো চার তরুণ আর ড্রাইভার। আততায়ীরা বুঝতে পারেনি তাদের অবস্থান।

বন্ধুকে ডেকে তুলে এবার একটু জিরিয়ে নেওয়ার পালা। তখনো লালমাটিয়ার রাস্তায় রাস্তায় খোঁজ দ্য সার্চ চালাচ্ছে পাজেরো, মাঝে মধ্যে ফাঁকাগুলি! একসময় বোধহয় চলে গেলো।

রাতটা নির্ঘুম কাটলো সবার। ভয়ে, আতঙ্কে… পরাণে শান্তি আনতে বন্ধু ঘরে থাকা হুইস্কির বোতলটা খুললো… জীবনে এই প্রথম বস্তুটা বড্ড বিস্বাদ ঠেকলো!

[১১ নভেম্বর ২০১০ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus