আল মাহমুদনামা

আল মাহমুদনামা

আল মাহমুদ বিষয়ে কিছুদিন পর পরই বিতর্ক ওঠে। মজার কথা হলো দুই পক্ষের কেউই তাকে মানুষ মনে করেন না। একদল তার যাবতীয় ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, আদর্শগত অবস্থান অর্থাৎ রক্ত মাংসের মানুষটাকে ভুলে আল মাহমুদকে বিবেচনা করতে চান শুধু কবি হিসেবে। আরেকদল তাকে যুদ্ধাপরাধী এবং মৌলবাদী শক্তি জামায়াতে ইসলামীর ঝাণ্ডা বহনকারী বিবেচনায় আক্ষরিক অর্থেই ‘অমানুষ’ মনে করেন।

আল মাহমুদের যে কবিতা আর সাহিত্যকর্ম নিয়ে তার পক্ষের লোকেরা লড়াই করেন, প্রাক্তন কবি আল মাহমুদ নিজেই তা প্রকারান্তরে অস্বীকার করে এখন। নেহায়েত পুরোপুরি অস্বীকার করলে তার কবি পরিচয়টাই বিলুপ্ত হয়ে যায়, বিক্রির আর কিছু থাকে না; তাই বাণিজ্যিক কারণেই সেই কবিতাগুলো অস্বীকার করাটা তার পক্ষে সহজ না, কারণ সেই কবিতাগুলোই এখনো তার কবি পরিচয়টা টিকিয়ে রেখেছে।

মুক্তিযুদ্ধের আগের কবি আল মাহমুদ আর মুক্তিযুদ্ধের পরের কবি আল মাহমুদের কবিতা পড়লেই তার পরিবর্তনটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের কবি আল মাহমুদের কবিতার রূপ রস গন্ধ বদলে যেতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থগুলোতে। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ দিয়ে যার শুরু।
যে কবি সোনালী কাবিনে লেখে:

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।

সেই আল মাহমুদই ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’য় লেখে:

মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান
বারুদই অন্তিম তৃপ্তি
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জিহাদ জিহাদ বলে জেগে উঠি

এই বিবর্তনটা কি শুধু কবিতায়? নাকি ব্যক্তি চেতনায়? একদা বামপন্থী বলে পরিচিত কবি আল মাহমুদ পাক্ষিক ‘সাপ্তাহিক’ পত্রিকার এক সাক্ষাতকারে বলে “ডানপন্থী বা বামপন্থী এসব আমি ঠিক বুঝি না। লেখক হিসেবে আমি মার্চ করেছিলাম। লেখক হিসেবেই আমার একটা পরিণতি হয়েছে। লেখকের একটা পরিণতি হয়। সে এক দিকে যায়। আমি বিশ্বাসের দিকে গিয়েছি। ঈমান-আক্বিদা এসবের কথা বলেছি। আমি মনে করি এটা ভালোই হয়েছে। ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখি আমি। আমি যখন ধার্মিক, বিশ্বাসী তখন আমার লেখায় তার প্রভাব তো পড়বেই”।
আল মাহমুদের ধর্ম বিশ্বাস আর ধর্মচর্চা নিয়ে আমার কিছু বলার নাই, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু কবিতার বিবর্তন আর সাক্ষাৎকারে বলা কথায় এটুকু পরিষ্কার বোঝা যায় যে কবি হিসেবে সোনালী কাবিন আমলে তার যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সেই যাত্রা পরিণতি পেয়েছে বর্তমানে এসে। এই পরিণতিপ্রাপ্ত বোধটাই আল মাহমুদ ধারণ করে, সোনালী কাবিন অতীত।
সমস্যা হলো আল মাহমুদ ভক্তরা এখনো কুমিরছানার মতো সোনালী কাবিনটাকেই বার বার সামনে এনে রাখেন। পরিণতিপ্রাপ্ত আল মাহমুদের কবিতা কি কখনো তারা রেফারেন্স হিসেবে সামনে আনেন? অন্তত আমার নজরে আসেনি।

আল মাহমুদের অনুসারীরা একসময় তাকে মুক্তিযোদ্ধা কবি দাবি করতেন। তাদের দাবি ছিলো আল মাহমুদই একমাত্র কবি যে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। সেই দাবি যে ভুল তা প্রমাণ করে গেছেন আরিফ জেবতিক, নতুন করে সেদিকে না যাই।

আল মাহমুদ বিষয়ে আরেকটা প্রচার খুব বেশি। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার তার উপর অনেক জুলুম নির্যাতন করেছে, বিনা বিচারে জেল খাটিয়েছে, এজন্যই এককালের ‘মুক্তিযোদ্ধা কবি’ ক্রমশ ঝুঁকে পড়তে থাকে জামায়াতে ইসলামীর দিকে। কী হাস্যকর।

তাহলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আল মাহমুদের কার্যক্রমগুলোতে একটু নজর রাখা যাক।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত রাষ্ট্রীয় চার-নীতির পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকাটির পুনঃপ্রকাশ শুরু হয়। এই শর্তেই বঙ্গবন্ধু রব-সিরাজদের হাতে পত্রিকাটির দায়িত্ব দেন। সম্পাদক তোহা খান। বঙ্গবন্ধুর এই পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আল মাহমুদের ক্যারিয়ার শুরু। পরবর্তীতে রব-জলিলের নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হলে গণকণ্ঠ জাসদের মুখপাত্র হয়ে যায়। তোহা খান, নির্মলেন্দু গুণ চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু আল মাহমুদ রয়ে যায়, হয়ে যায় সম্পাদক। রব-জলিল তখন তার নেতা।
নির্মলেন্দু গুণের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়:

মনে পড়ে, ১৯৭৩ বা ৭৪ সালে চট্টগ্রামে আমরা কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন এবং আমি। রাতে চট্টগ্রাম পোর্টের ডাক্তার কামালের বাসায় আমাদের নৈশভোজের ব্যবস্থা ছিল। সঙ্গে ছিল সুরা। এক পর্যায়ে শামসুর রাহমানের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আল মাহমুদের তুমুল তর্ক বেঁধে যায়। শামসুর রাহমান তর্কপটু মানুষ ছিলেন না। তাই শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী তখন শামসুর রাহমানের পক্ষ হয়ে আল মাহমুদের আক্রমণের জবাব দিতে উঠে দাঁড়ান। আল মাহমুদ যে রব-জলিলের খুঁটির জোরেই আজকাল এমন নর্তন-কুর্দন করছে দেবুদা ঐ কথাটা খুবই জোরের সঙ্গে উত্থাপন করলেন, কারও ভুলে যাবার কথা নয় ঐ নয়নমনোহর দৃশ্যটি, আল মাহমুদ তড়াক করে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে একটি সোফার ওপর লম্ফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর, মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে, শতকরা একশ’ভাগ সাফল্যের সঙ্গে, পুরোপুরি সামরিক কায়দায় তাঁর তখনকার প্রিয় দুই নেতা রব-জলিলের উদ্দেশে স্যালুট নিবেদন করে বলেন… ‘সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন সব ব্যাটাই রব-জলিলের নামে এইভাবে স্যালুট দেবে’।

কিন্তু সেদিন খুব বেশি দূরে থাকেনি যেদিন আল মাহমুদ নিজেই রব-জলিলের নাম ভুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়। ক্রমাগত রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার কারনে একসময় তাকে জেলে যেতে হয়। কিন্তু মুক্তির পরদিনই বঙ্গবন্ধু নিজে আল মাহমুদকে ডেকে নিয়ে চাকরি দেন।

আমি জেল থেকে বেরিয়ে রাতটা শুধু কাটিয়েছি। সকালবেলা আমার বাড়িতে টেলিফোন আসে। ওনার সেক্রেটারি টেলিফোন করে বলেছেন, শেখ সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি যেন সেখানে চলে যাই। আমি গিয়েছি। তিনি আমাকে একটা চাকরির অফার দিয়েছেন। আমি তাকে বলেছি যে, আমি আমার পেশায় (সাংবাদিকতা) থাকতে চাই। কিন্তু তিনি সেটা করতে দেননি। তিনি আমাকে শিল্পকলা একাডেমীতে জয়েন করতে বলেছেন। আমি অনেক চিন্তা করে সেটা করেছি। এটাও তো একটা ঋণ। তিনি যেখানে তার বিরোধীদের সহ্যই করতেন না একদম, সেখানে আমার মতো একজন কবিকে তিনি একটা সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করলেন, এটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। আমি মনে করি, এটা একটা ঋণই বটে।

প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু নিজে ডেকে নিয়ে আল মাহমুদকে শিল্পকলা একাডেমীর উপপরিচালক পদে চাকরি দেন। পরে পরিচালক পদেও চাকরি হয়। প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও নিজ দায়িত্বে বঙ্গবন্ধু তাকে চাকরি দেন। আল মাহমুদের অনুসারীরা তার প্রতি বাকশাল সরকারের জেল জুলুমের কথাই শুধু বলে। কিন্তু আল মাহমুদ নিজে সেই অবস্থান থেকে সরে গেছে বহু আগে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখে ফেলেছে গোটা একটা উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’। আর বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিজে যোগ দিয়েছে বাকশালে। বলা প্রয়োজন শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণরা কিন্তু বাকশালে যোগ দেন নাই; আল মাহমুদ দিছে। জাসদ, সমাজতন্ত্র, রব-জলিল ভুলে যেতে আল মাহমুদের সময় লাগেনি একটুও।

এই যে চোখ পল্টি দেওয়া, ভোল পাল্টে ফেলা… এটাই আল মাহমুদ। এই আল মাহমুদটাই সত্যি।

এটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আল মাহমুদ যখন সব ভুলে জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় মাঠে নামে।

একবার উনি (জিয়া) আমাকে ডেকে পাঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করেন। আমাকে জাসাসের সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই সময় প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাকে খুব উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এটা আমার মনে আছে খুবই যে, তিনি বলেছিলেন ‘এটা আপনাকে করতে হবে’। আমি করেছিলাম। জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও আমার বহু বিনিময় হয়েছে। কথাবার্তা হয়েছে। আমি তাকে অত্যন্ত দেশপ্রেমিক এক মহৎ হৃদয়ের মানুষ মনে করি। রাষ্ট্রনায়কসুলভ সব গুণই তার ছিল।

অতঃপর গঠিত হয় জাসাস, আল মাহমুদ যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় আল মাহমুদ সুখে থাকে। লোকটা পল্টিবাজ হলেও একেবারে অকৃতজ্ঞ না, জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করতেও নিজের সাহিত্য প্রতিভা ব্যবহার করে। ‘তৃষিত জলধি’ নামে একটা গল্প লেখে জিয়ার নামে। আল মাহমুদই সম্ভবত একমাত্র কবি, বঙ্গবন্ধু আর জিয়া দুজনকে নিয়েই যার কবিতা সমাদৃত হয়েছে। অবশ্য জিয়া, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, জাসাস ইত্যাদি থেকে চোখ ওল্টাতেও সময় লাগে না আল মাহমুদের।

এরশাদ ক্ষমতায় আসে। সমস্যা হলো এরশাদ নিজেই কবি। শোনা যায় এরশাদের নামে তখন কবিতা লিখে দিতো অনেক প্রথিতযশা কবিই। সেই দলে আল মাহমুদ ছিলো কি না তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই তারা নিজেরা স্বীকার না করা পর্যন্ত। তবে এরশাদ যে কবিতার সম্মেলন ডেকেছিলো, দেশের বরেণ্য সব কবিরা তার বিপক্ষে থাকলেও আল মাহমুদ এরশাদের কবলেই ছিলো। এরশাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কথা আল মাহমুদ সবসময়ই স্বীকার করেছে।

এইসব নানাবিধ পল্টিবাজির পর আল মাহমুদ অবশেষে থিতু হয় জামায়াতে ইসলামীতে এসে। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী শক্তির হয়ে এখন আল মাহমুদের লড়াই চলছে। বিবর্তনের এই বিস্তারিত চিত্র খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে লেখা আছে হাসিব মাহমুদের এই পোস্টে

এক সোনালী কাবিন বিক্রি করে কবি পরিচিতি পাওয়া আল মাহমুদের মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালের এই সুদীর্ঘ সময়ে কোনো উল্লেখযোগ্য কবিতা নেই। আছে দলবাজি, পল্টিবাজি। আছে যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী আর মৌলবাদী শক্তি জামায়াতে ইসলামীর হয়ে ল্যাদানোর ইতিহাস।

এই পচে গলে যাওয়া লোকটাকে আমরা এখনো কবি হিসেবে মাথায় তুলে রাখতে চাই!

আল মাহমুদের সোনালী কাবিন থেকেই উদ্ধৃত করি:

কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক
শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ‘পরে।
পূর্ব পুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?

বিবেক বিক্রয় করে বাক্যের খোঁয়াড় বানিয়ে পাহাড় গড়ে তোলা বর্তমানের আল মাহমুদ কি এই কবিতা এখনো বিশ্বাস করবে নাকি অস্বীকার করবে?

পুনশ্চ: একবার এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো দীর্ঘদিন শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্বে থেকে তার উল্লেখযোগ্য অবদান কী? আল মাহমুদের উত্তর ছিলো সেখানে সে শুধু চাকরি করতে গেছে, কোনো অবদান রাখতে যায়নি।

পুন পুনশ্চ: জামাত তোষণের অপরাধে হুমায়ুন আজাদ তাঁর সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত কবিতা’ বইতে আল মাহমুদের কবিতা বর্জন করেছিলেন।

[১২ জুন ২০১৫ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus