গেন্দা ফুল কেন লাল

গেন্দা ফুল কেন লাল

জেনিফার লোপেজ আর শাকিরা তাদের কোনো একটা চটকদার গানের মাঝখানে যদি এক ঝলক গেয়ে উঠতেন ‘বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল এমন মাথায় বিন্ধ্যে দিবো লাল গেন্দা ফুল’। আর তখন শাকিরা একটা লালপেড়ে সাদা শাড়ি সঙ্গে টুকটুকে লাল ব্লাউজ পরে একটু নেচেও দিতেন… তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতো?

খুশি হতাম কি আমরা?

হয়তো জেলো আর শাকিরার উচ্চারণ অনিচ্ছাকৃতভাবেই প্রমিত বাংলার হতো না, শুনতে বিকৃত বাংলা লাগতো। হয়তো তাদের শাড়ি পরাটাও খুব একটা সঠিক হতো না, ব্লাউজটা হতো আরো একটু লোকাট… পেছনের সখিদের নাচের মুদ্রার বাঙালিয়ানাতেও থাকতো নানাবিধ সমস্যা…

তবু কি আমাদের খারাপ লাগতো? নাকি আমাদের ভালো লাগতো বাংলার এই বিশ্ববিহার দেখে? নাকি আমরা বাংলা ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি গেলো তল বলে তলোয়ার নিয়ে জেলো আর শাকিরার ফাঁসি চেয়ে মিছিল শুরু করতাম?

সম্ভবত দুইরকম প্রতিক্রিয়াই হতো। আমরা বাঙালিরা দুইদলে ভাগ হয়ে পরষ্পর ঝগড়া ফ্যাসাদ করতাম কয়েকদিন। না খেয়ে না নেয়ে কাছা দিয়ে লড়াই করতাম। পত্রিকায় হয়তো খবর আসতো অমুক গ্রামে সংঘর্ষে দুজন আহত। যদিও তাতে জেলো আর শাকিরার কিছুই আসতো যেতো না।

বাদশা নামের একজনের একটি মিউজিক্যাল প্রোডাক্ট ইউটিউবে এসেছে দুদিন হলো। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজির মিশ্রনে সেই প্রোডাক্ট তৈরি। মূল অংশে ব্যাবহার করা হয়েছে বাংলা ভাষার প্রচলিত গান ‘বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথায় বিন্ধ্যে দিবো লাল গেন্দা ফুল’ এর স্থায়ী অংশটি। এটুকু গেয়েছেন পায়েল দেব। তিনি সম্ভবত বাঙালি।

সনি মিউজিক ইন্ডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে গানটির ক্রেডিট লাইনে লেখা হয়েছে এই গানটির লিরিক এবং কম্পোজিশন করেছেন বাদশা। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন আদিত্য দেব। সম্ভবত তিনিও বাঙালি। বাদশাও কি বাঙালি? জানি না। ক্রেডিট লাইনে লিরিক এন্ড কম্পোজিশন বাদশা লেখার ঠিক আগের লাইনেই লেখা হয়েছে ‘অরিজিনাল লিরিক: বেঙ্গলি ফোক’।

গানের চিত্রায়নেও বেশ কিছুটা বাঙালিয়ানা আছে। জ্যাকুলিন আর তার সখিরা পরেছেন লালপেড়ে সাদা শাড়ি, সঙ্গে টুকটুকে লাল ব্লাউজ। সেট এবং কোরিওগ্রাফিতেও আছে বাঙালিয়ানা, নাচের মুদ্রায় আছে দোতরা বাজানোর ঢঙ।

আমরা যথারীতি দুভাগ হয়েছি। একদল জ্যাকুলিনকে দেখতে ভীড় জমিয়ে ভিউ বাড়াচ্ছি, আরেকদল খুব নিন্দে করছি।

নিন্দের সবচেয়ে বড় অংশটা কপিরাইট ইস্যু। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আর এই ইস্যুতে এসেছে রতন কাহারের নাম। যিনি এই গানটির স্রষ্টা। এই পুরো বিষয়টার সূত্র কলকাতার ’এই সময়’ পত্রিকার একটি রিপোর্ট। দুবছর আগের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখের এই রিপোর্ট ছাড়া ‘গেন্দা ফুল’ গানের সঙ্গে রতন কাহারের আর কোনো সূত্র খুঁজে পাইনি।

রতন কাহার গানটি লিখেছিলেন ১৯৭২ সালে। রেডিওতে গেয়েওছিলেন। কিন্তু গানটি রতন কাহারের কণ্ঠে পরিচিতি পায়নি। ১৯৭৬ সালে যখন অশোকা রেকর্ড কোম্পানি গানটি স্বপ্না চক্রবর্তীর কণ্ঠে নতুন করে রেকর্ড করে বাজারে ছাড়ে, সেখান থেকে গানটি মানুষের কাছে পরিচিতি পেতে শুরু করে। ’এই সময়’ এর রিপোর্টেই উল্লেখ আছে স্বপ্না চক্রবর্তীর কণ্ঠে গানটি প্রচারের পর থেকেই ‘লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে। জেতে গোল্ডেন ডিস্ক পুরষ্কারও।’

স্বপ্না চক্রবর্তীর গানটি ইউটিউবে আছে। সেখানে গানটির সুরকার হিসেবে উল্লেখ আছে চন্দ্রকান্ত নন্দীর নাম। গীতিকার হিসেবে কারো নাম নেই, লেখা আছে ‘প্রচলিত’। অশোকা রেকর্ডের অ্যালবাম দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু ইউটিউবের এই ক্রেডিট লাইন সম্ভবত সেই অ্যালবাম থেকেই নেওয়া হয়েছে, স্বপ্না চক্রবর্তীর ছবিও। তাহলে সেখানে রতন কাহারের নাম নেই কেন?

১৯৭৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গানটি রতন কাহারের নাম ছাড়াই জনপ্রিয় হয়েছে। কেউ আপত্তি তোলেনি। কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি।

এখন বাদশা, পায়েল, জ্যাকুলিনের কল্যাণে ’গ্যান্দা ফুল’ নাম নিয়ে নতুন করে বাজারে এসেছে। আমরা ‘এই সময়’ এর রিপোর্ট অনুসরন করে রতন কাহারের গান বাদশা চুরি করে নিলো বলে ফেসবুক মাতাচ্ছি। সেই আমরাই আবার গানটির সুরকার চন্দ্রকান্ত নন্দীও যে একইরকম বঞ্চিত হচ্ছেন, সেকথা বলছি না। কারন আমরা আসলে জানিই না।

বাদশা মিয়ার গানটি বাজারে আসায় অন্তত একটা বড় উপকার হলো, এই দারুণ গানটি রচনার পেছনের নির্মম ইতিহাস জানা গেলো, জানা গেলো গীতিকার রতন কাহারের নাম। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই ডামাডোলের উৎপত্তি না হলে আজীবন এই গানের গীতিকার ‘প্রচলিত’ ভাই-ই থেকে যেতো, রতন কাহার অজ্ঞাতই থাকতেন। যেভাবে আমার এই লেখাটা একসময় ফেসবুকে ‘কালেক্টেড’ ভাইয়ের লেখা হয়ে যাবে, ঠিক সেভাবে।

এবার যদি এই উছিলায় রতন কাহার ফিরে পান হারানো স্বীকৃতি, কপিরাইট ইস্যুতে গীতিকারের প্রাপ্য সম্মানী পান, তাহলে এটা ভালোর চেয়ে মন্দ হবে না কোনোভাবেই। গানটির প্রকৃত সুরকার যদি চন্দ্রকান্ত নন্দী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকেও প্রাপ্য সম্মানী এবং সম্মান দেওয়া কর্তব্য। এর জন্য ফেসবুকে ইমোশনাল হাউকাউ করার প্রয়োজন নেই, রতন কাহারের পক্ষ হয়ে যে কেউ মামলা ঠুকে দিলেই চলবে। আদালতই যা করার করবে।

শুধু কপিরাইট না, এই মিউজিক্যাল প্রোজেক্টের বিরুদ্ধে যৌনবাদী অভিযোগ আছে। সে অভিযোগ আসলে এরকম যে কোনো মিউজিক্যাল প্রোজেক্টের বিরুদ্ধেই তীব্রভাবে আছে। বলিউড, ঢালিউড থেকে শুরু করে কাঙালিনী সুফিয়ার ‘উপরতলায় টানিও গুন বৈঠা মাইরো নিচতলায়’ কিংবা নার্গিসের ‘বন্ধু টিপ্পা টিপ্পা খাইয়ো রে আমার গাছের আম’ পর্যন্ত সর্বত্রই এই অভিযোগ বিরাজমান। এর কোনো বিচার নাই।

আরেক বড় অভিযোগ বাংলা ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি ধ্বংশ হয়ে যাওয়ার। বাংলা আর বাঙালির ঐতিহ্য সংস্কৃতি যদি এতো ঠুনকোই হয় যে কোথাকার কোন বাদশা মিয়া একটা গান গাইলো আর জ্যাকুলিন কোমর দুলিয়ে নাচলো বলে তার জাত চলে যাবে, তাহলে সেই জাত যেতে দেওয়াই ভালো। অযথা পুলিশ দারোয়ান দিয়ে পাহারা বসিয়ে রক্ষার অপচেষ্টা করে লাভ নেই। সলীল চৌধুরীর ভাষায় ‘যাক যা গেছে তা যাক’ বলে আমরা অসংস্কৃত হয়ে যাবো।
এত্তো সোজা? হাজার বছর ধরে বাংলা সংস্কৃতি কি তবে ঘোড়ার ঘাস কেটেছে যে একটা গানেই তা উজড়ে যাবে? এতো ডরান ক্যান ভাই?

অনেকেই বলছেন গান ভালো লাগেনি। এই প্রসঙ্গে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার। কোন গান দেখার আর কোন গান শোনার তা আমি খুব সহজেই বুঝতে পারি। হাতুড়ি দিয়ে যেহেতু কোনোদিন স্ক্রুর প্যাঁচ খোলার চেষ্টা করিনি… সেহেতু যে গান দেখার, সে গান শুনে সময় নষ্ট করার চেষ্টা করিনা কখনো।

আর এই যে ‘গ্যান্দা ফুল’ এটা আদতে কোনো গান না। শুরু থেকেই বলে আসছি, এটা একটা মিউজিক্যাল প্রজেক্ট। বাদ্যযন্ত্র, সুর-বেসুর, লিরিক, জমকালো সেট, যৌনাবেদনময়ী মডেল, আকর্ষণীয় কোরিওগ্রাফি, ঝকমকে সিনেমাটোগ্রাফি, ধামাকা এডিটিং, চকচকে কালার গ্রেডিং ইত্যাদি মিলিয়ে এটা একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। ব্যাপারটাকে যদি আমরা কাচ্চি বিরিয়ানির সঙ্গে তুলনা করি, যেখানে অনেক পদের মশলা লাগে… সে হিসেবে এখানে মডেল কোরিওগ্রাফি ইত্যাদি থাকবে খাসির মাংস, পোলাওয়ের চাল লেবেলে আর গান থাকবে পেঁয়াজ বেরেস্তা লেবেলে।

গান শুনতে চাইলে দুনিয়াতে ভালো ভালো শিল্পীরা আছে, তাদের গান শোনেন। নাচ দেখতে চাইলে ভালো নাচ দেখেন। সুন্দরী নারী বা ততোধিক কিছু দেখতে চাইলে গুগলে অনেক কিছু পাবেন। করোনার দিনে পর্নহাবও ফ্রি। বাই দ্য ওয়ে, পর্নহাবে গিয়ে আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত সার্চান নাকি সানী লিওনি? কোথায় কী খুঁজতে হবে আর কোথা থেকে কী প্রত্যাশা করতে হবে সেটুকু জানা বোঝা খুব জরুরী। ভুল জায়গায় ভুল জিনিস খুঁজলে সময় নষ্ট হবে, পস্তাবেন। শুধু শুধু কেন একটা মিউজিক্যাল প্রজেক্টের ঘাড়ে সঙ্গীত, বাংলা সংস্কৃতি ইত্যাদির দায় চাপাচ্ছেন? এগুলো তো এতো সস্তা না বাবা!

সেই হিসেব মতে ‘গ্যান্দা ফুল’ বেশ দারুণ প্রজেক্ট। হিট। সঙ্গে বিতর্কও আছে… এটা বাড়তি মাশালা। করোনাক্রান্তি গেলেই দেশে বিয়ের হুজুগ লাগবে। আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিডিউল বুকড। গায়ে হলুদে নাচার জন্য তখন অনেক গানের দরকার হবে। লুঙ্গি ড্যান্স, মুন্নীর বদনাম দিয়ে আর কয়দিন চলবে? ’গ্যান্দা ফুল’ সেখানে দারুণ যোগান। এবছর যাবতীয় হলুদের অনুষ্ঠানে এই নাচের ধুম লেগে যাবে নিশ্চিত। এতদিন বিয়ের অনুষ্ঠানে ’বউ কতো সুন্দর’ বা ’বউয়ের গয়নার ওজন কতো’ বা ’বিরিয়ানীর স্বাদ’ বা ’ওয়েডিং ফটোগ্রাফি’ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা চলতো। এবছর শুরু হবে গ্যান্দা ফুলের সঙ্গে কার নাচ কতো ভালো হলো। যার হলুদের অনুষ্ঠানে এই নাচের পার্ফর্মেন্স মন্দ হবে তার বিয়া হিট হবে না। বাসর রাতেই ঝগড়া হবে, কনফার্ম।

ব্যাপারটা শুধুই যে নাচাগানা, তা না। এর সঙ্গে দেশের অর্থনীতি আর উন্নয়নেরও যোগ আছে। বাংলাদেশে হলুদ গ্যান্দা ফুলের দাম বেশি, প্রতি মালা ৫০ টাকা। আর লাল গ্যান্দা ফুলের দাম কম, প্রতি মালা ৪০ টাকা। সরবরাহও কম, কারন কেউ কেনে না। সবাই হলুদ গ্যান্দা ফুল পছন্দ করে।

নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এবছর ফুলের বাণিজ্যে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে এই গান। গ্যান্দা ফুল চাষীরা এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারেন। এবছর লাল গ্যান্দা ফুলের বাণিজ্য বাম্পার যাবে। দাম দ্বিগুন হবে। হলুদ গ্যান্দা ফুলের দিন শ্যাষ।

যাহোক, বাংলা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে টেনশন করার কিছু নাই। করোনাকাল পার হলে রতন কাহার, চন্দ্রকান্ত নন্দী আর স্বপ্না চক্রবর্তীর হয়ে কেউ একটা কপিরাইট মামলা ঠুকে দিয়েন। আপাতত সবাই ঘরে থাকেন আর আদব তমিজের দৃষ্টিতে জ্যাকুলিনরে দেখেন…

সংযোজন:
রতন কাহারের সাক্ষাৎকার পাওয়া গেলো একটা, জানা গেলো স্বপ্না চক্রবর্তী, চন্দ্রকান্ত নন্দী এবং অশোকা রেকর্ডসও ১৯৭৬ সালে ঠিক সেই কাজটিই করেছিলো, যা এখন করেছে বাদশা, পায়েল এবং সনি এন্টারটেইনমেন্ট। স্বপ্না চক্রবর্তী নিজের অ্যালবামে গানটি রতন কাহারের ক্রেডিট ছাড়াই গেয়েছিলেন, সেটিই জনপ্রিয় হয়েছিলো। সেখানে সুরকার হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিলো চন্দ্রকান্ত নন্দীকে।

স্বপ্না চক্রবর্তী এখনো জীবিত, বাদশা মিয়ার সঙ্গে তাকেও কাঠগড়ায় তোলা উচিত। অন্যায়ের শুরুটা বোধহয় তার হাত ধরেই, বাকিরা এবং বাদশা স্রেফ কপি পেস্ট করেছে।

এবং এটাই সত্যি যে গত ৪৪ বছর ধরে এই অন্যায় হয়ে চলেছে, কেউ প্রতিবাদ করেনি। রতন কাহার কোনো স্বীকৃতি, সম্মান এবং সম্মানী পাননি। এবার বাদশা এ গান করায় অন্তত সমস্যাটা সামনে এসেছে। এবার মিটিয়ে ফেলতে হবে। শুনেছি আইনি ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছে… সাধু।

শুভ সন্ধ্যা

পুনশ্চ: গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অন্যতম হিট আইটেম গান ‘ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদীনায়’। কাতারে কাতারে এই গান কভার হইতেছে মূল গান পবন দাস বাউলের কৃতিত্বে। অথচ এই গানটার মূল কারিগর আমাদের আব্দুর রহমান বয়াতী। সেই কথা কয়জন জানেন? কেউ তার কপিরাইট টেকাটুকা নিয়ে কথা তুলছেন?

ভাবতেছি এখনকার ক্রেইজ বিটিএস বা জাস্টিন বিবারকে দিয়ে নৌকা ছেড়ে দেবো… তাতে যদি আব্দুর রহমান বয়াতীর কপালে কিছু জোটে

[২৯ মার্চ ২০২০ তারিখে ফেসবুকে এবং ৩০ মার্চ তারিখে ঢাকা ১৮.কমে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus