‘নতুন কুড়ি’ তুমি কার?

‘নতুন কুড়ি’ তুমি কার?

ঢাকার ডিআইটি ভবনের ছোট্ট পরিসর থেকে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তারিখে শুরু হয় উপমহাদেশের প্রথম নিয়মিত টেলিভিশন সম্প্রচার। যা ১৯৬৫ সালের ২৫ মার্চ থেকে পিটিভি নামে সম্প্রচারিত হতে থাকে।

শুরু থেকেই সেখানে ছোটদের অনুষ্ঠান ছিলো জনপ্রিয়। জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও ’টাপুর টুপুর’ সম্পাদক এখলাস উদ্দিন আহমদের উপস্থাপনায় প্রথম ছোটদের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। তবে এর পরবর্তীতে ছোটদের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই হতো শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার-এর উপস্থাপনায়। ছোটদের অনুষ্ঠান তিনি প্রযোজনাও করতেন। ছোটদের জন্য বাঘা আর মিনি নামে দুটো পাপেট বানিয়েছিলেন, বিটিভির দর্শকের কাছে সেগুলো এখনো জনপ্রিয়।

মুস্তাফা মনোয়ারই প্রথম পরিকল্পনা করেন ছোটদের জন্য পড়াশোনার বাইরে গান, কবিতা, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি, ছবি আঁকা প্রভৃতির প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের। সে অনুযায়ী ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ছোটদের প্রতিযোগিতার অর্থাৎ নতুন প্রতিভা অন্বেষণের কাজ শুরু হয়। প্রখ্যাত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর ‘একজীবনে টেলিভিশন’ নামের বইয়ের (অন্যপ্রকাশ, ২০০৮) ৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন-

যে কারণে ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন ছোটদের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে অর্থাৎ নতুন প্রতিভা অন্বেষণের কাজ শুরু করেছিল। ছোটদের এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্য টেলিভিশনে প্রথম ঘোষণা দেয়া হয় আবেদনপত্র জমা দেয়ার। ২৫ মিনিটের অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা থাকত ৮ থেকে ১২ জন। প্রথম পরিকল্পনা করা হয় ১৩টি অনুষ্ঠানের। টেলিভিশনে প্রথম থেকেই ত্রৈমাসিক অনুষ্ঠান সূচি তৈরি হতো। যে কারণে সব অনুষ্ঠানের সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ১৩টি পর্ব প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।

[ফরিদুর রেজা সাগর এর ’একজীবনে টেলিভিশন’ বইয়ের প্রচ্ছদ]

উল্লেখ্য ছোটদের জন্যও পুরো উপমহাদেশে এটাই ছিলো প্রথম প্রতিযোগিতামূলক টেলিভিশন অনুষ্ঠান। যার পরিকল্পনাকারী ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। অনুষ্ঠানটি স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। উপস্থাপনা করতেন মাসুমা খাতুন, পরবর্তীতে যিনি ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দিয়েছিলেন। কখনো কখনো মুস্তাফা মনোয়ার নিজেও উপস্থাপনা করতেন। তখন প্রযোজনা করতেন জামান আলী খান বা আবদুল্লাহ আল মামুন। প্রতিযোগিতায় তিনজন বিচারক থাকতেন।

এই অনুষ্ঠানটির নাম কী ছিলো তা জানতে পারিনি। কিন্তু এই প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানটির নাম যে ‘নতুন কুঁড়ি’ ছিলো না, তা নিশ্চিত। তবে পরবর্তীকালে এটাই ’নতুন কুঁড়ি’ শিরোনাম পায়। ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর ‘একজীবনে টেলিভিশন’ বইয়ের ৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন লিখেছেন-

পরবর্তী পর্যায়ে টেলিভিশনের এই ছোটদের অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’ শিরোনামে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছিল।

যদিও এই পরবর্তী পর্যায়টা কতো সালে তা তিনি উল্লেখ করেননি।

[একজীবনে টেলিভিশন বইয়ে নতুন কুঁড়ির শুরুর কথা]

প্রখ্যাত ছড়াকার ও কথাসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন ২০০৫ সালে ‘বিটিভির নতুন কুঁড়ি> মুস্তাফা মনোয়ারের কৃতিত্ব কী ভাবে ছিনতািই হয়ে গেলো জিয়ার নামে?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। যা ২০১১ সালে নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘দৈনিক আমাদের সময়’ পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। সেখানে তিনি তুষার আবদুল্লাহ ও জাবির মাহমুদ সম্পাদিত ‘তোমাদের প্রিয়জন’ নামের বই (সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৩১) থেকে মুস্তাফা মনোয়ারের সাক্ষাৎকার থেকে একটি উদ্ধৃতি দেন-

নতুন কুঁড়ির কথা তো তোমরা সবাই জান। সবাইকে তোমাদের প্রতিভার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ‘৬৯ (ঊনসত্তর) সালে টেলিভিশনে আমি তোমাদের জন্য এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। প্রথমবার শুধু ঢাকার বন্ধুদের নিয়ে ৮/৯টি বিষয়ের ওপর প্রতিযোগিতা হয়। প্রথমবার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় সরাসরি। রেকর্ডিং এর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমার বাবা কবি গোলাম মুস্তাফার ‘নতুন কুঁড়ি’ কবিতার নামে অনুষ্ঠানের নাম রাখা হয়। নতুন কুঁড়ির শুরুতে যে গানটি শোন, সেটিই নতুন কুঁড়ি কবিতা। পরে ‘৭৪ (চুয়াত্তর)-এ ১২টি বিষয় নিয়ে সারা বাংলাদেশের বন্ধুদের একত্রিত করে নতুন কুঁড়ির আয়োজন করা হয়।

[মুস্তাফা মনোয়ার ও লুৎফর রহমান রিটন]

প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো সংখ্যার ভুল। ৬৬ আর ৬৯ এর মধ্যে কোনো এক জায়গায় ‘প্রিন্টিং মিসটেক’ আছে। ‘একজীবনে টেলিভিশন’ বইটি চেক করে দেখা গেলো ৬৬ সালই লেখা। প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদ ডেইলি স্টারেও ছাপা হয়েছে। সেখানেও ৬৬ই লেখা। ‘তোমাদের প্রিয়জন’ বইটি সংগ্রহে ছিলো না। কিন্তু বইটির অন্যতম সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক তুষার আবদুল্লাহ ফোনে নিশ্চিত করলেন যে মুস্তাফা মনোয়ার ৬৯ সালের কথাই বলেছেন।

সেক্ষেত্রে ধারণা করা যায় ৬৬ সালে শিশুদের জন্য যে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিলো, ৬৯ সালে তা ’নতুন কুঁড়ি’ নামে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শুরু হয়। মুস্তাফা মনোয়ারের সাক্ষাৎকার থেকে আরো জানা যায় যে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭৪ সালে ’নতুন কুঁড়ি’ শুরু হয়। সূচনা সঙ্গীত হিসেবে সংযুক্ত হয় মুস্তাফা মনোয়ারের বাবা বিশিষ্ট কবি গোলাম মুস্তাফার কবিতায় সুরারোপিত গান। কবিতাটির পরিচয় দিতে গিয়ে মুস্তাফা মনোয়ার ‘নতুন কুঁড়ি’ বললেও কবিতাটির মূল নাম সম্ভবত ‘কিশোর’।

কিশোর

গোলাম মুস্তাফা

আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি পাতার বন্ধনে।
সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবো মোরা ফুটবো গো,
অরুণ রবির সোনার আলো দু’হাত দিয়ে লুটবো গো।
নিত্য নবীন গৌরবে
ছড়িয়ে দেব সৌরভে,
আকাশ পানে তুলব মাথা, সকল বাঁধন টুটবো গো।
সাগর জলে পাল তুলে দে, কেউবা হবে নিরুদ্দেশ,
কলম্বসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবে নতুন দেশ।
জাগবে সারা বিশ্বময়।
এ বাঙালী নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি-সাহস আজও এদের হয় নি শেষ।

[গানটির ইউটিউব লিঙ্ক]

[গানের সুরকার, সঙ্গীতায়োজক ও শিল্পীর নাম পরবর্তীতে জেনে যুক্ত করা হবে]

’নতুন কুঁড়ি’ অনুষ্ঠানটিকে বড় আয়োজনের রূপকার ছিলেন বিটিভির প্রযোজক কাজী কাইয়ুম। ফরিদুর রেজা সাগর এবং লুৎফর রহমান রিটন ‘নতুন কুঁড়ি’ সংক্রান্ত আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে কাজী কাইয়ুমের প্রসঙ্গ এনেছেন। ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর ‘বাংলা টেলিভিশনের ৫০ বছর’ নামের সংকল গ্রন্থের ৩৯৬ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন-

বলা যেতে পারে, শুধু মানুষকে সাহায্য করা নয়, ছোটদের অনুষ্ঠানকে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে একা আগলে রেখেছিলেন কাজী কাইয়ুম। ছোট করে শুরু হওয়া ‘নতুন কুঁড়ি’ অনুষ্ঠানকে সারা দেশের অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে কত বড় করে প্রচার করা যায় তার ব্যাপক পরিকল্পনা শুধু নয়, বাস্তবতারও প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন কাজী কাইয়ুম।

অর্থাৎ মুস্তাফা মনোয়ারের পরিকল্পনায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’ জনপ্রিয়তা এবং ব্যাপ্তি পেয়েছিলো কাজী কাইয়ুমের হাত ধরে।

[ফরিদুর রেজা সাগর-এর ‘বাংলা টেলিভিশনের ৫০ বছর’ বইয়ের প্রচ্ছদ]

কিন্তু ‘নতুন কুঁড়ি’কে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বপ্নপ্রসূত বলে সর্বদাই প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং দলীয় বুদ্ধিজীবীরা সেরকমটাই প্রচার করার চেষ্টা করেন সবসময়। সেই প্রচারণার তোরে সাধারণ মানুষ এমনকি বিটিভি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ’নতুন কুঁড়ি’কে জিয়ার প্রোডাক্ট হিসেবেই জানেন।

৩ সেপ্টেম্বর ২০০৩ তারিখে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আলী ইমামের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন আর্কাইভস’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়। বইটির শুরুতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাজমুল আলম সিদ্দিকী ও বিটিভির তৎকালীন মহাপরিচালক মুস্তাফিজুর রহমানের বাণী সংযুক্ত ছিলো।

বইটি শুরুরও আগে একেবারে প্রথমে রঙিন পাতায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরিচিতি পর্যায়েরও একেবারে শুরুতে দ্বিতীয় অধ্যায়েই ‘নতুন কুঁড়ি’ নামক অধ্যায় ছাপা হয়। অর্থাৎ বিটিভির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হিসেবে ‘নতুন কুঁড়ি’র নাম নেওয়া হয়। উল্লেখ্য সেখানে ‘নতুন কুঁড়ি’ ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানের নামেই আলাদা অধ্যায় লেখা হয়নি। প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘নতুন যুগ’, যেখানে ১৯৮০ সাল থেকে যে বিটিভি রঙিন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করে তার বিবরণ। এবং অবশ্যই সেখানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার জয় জয়কার।

’নতুন কুঁড়ি’কে এতোটা গুরুত্ব দেওয়া হলেও খুবেই আশ্চর্যের ব্যাপার, সেখানে কোথাও উল্লেখ নেই এই অনুষ্ঠানটি কবে থেকে শুরু হলো। জিয়াউর রহমানই বা কবে এই উদ্যোগ নিলেন!

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি চমৎকার উদ্যোগ হলো ‘নতুন কুঁড়ি’। জাতীয় টেলিভিশন শিশু শিল্পী পুরস্কার প্রতিযোগিতা। এই উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় সমস্ত দেশ থেকে। শিশু শিল্পীদের মাঝে পড়ে যায় অভূতপূর্ব সাড়া। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার এই সুন্দর স্বপ্নের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

পুরো লেখায় শুধু এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে-

শিশুদের একান্ত বন্ধু ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। টেলিভিশনের জাতীয় শিশু শিল্পী পুরস্কার প্রতিযোগিতার দুই শাখার শ্রেষ্ঠতম শিশু শিল্পীদের সোনার কাপ উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছিলেন তিনি ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর। কারণ তাঁর অঙ্গীকার ছিল নতুন বাংলাদেশ গড়ার। যে গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করবে দেশের সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা।

এই ব্যাস! মুস্তাফা মনোয়ারের স্বপ্ন, পরিকল্পনা, মেধা ও পরিশ্রমে ১৯৬৬ সাল থেকে যে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে আসছে। কাজী কাইয়ুমের মেধা এবং চেষ্টায় যে ‘নতুন কুঁড়ি’ সমৃদ্ধ হয়েছে, ১১ বছর পর শুধু একটা সোনার কাপ উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সেই স্বপ্ন আত্মসাৎ করে নেওয়া হলো। ‘নতুন কুঁড়ি’ হয়ে গেলো জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের ফসল!

[বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন আর্কাইভস’ বইয়ের প্রচ্ছদ ও নতুন কুঁড়ির ভ্রান্ত ইতিহাস সম্বলিত পৃষ্ঠা]

comments powered by Disqus