নিরাপদ আছি, মুক্ত আছি, স্বাধীন আছি, বেঁচে আছি

নিরাপদ আছি, মুক্ত আছি, স্বাধীন আছি, বেঁচে আছি

আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে প্রথমে দেওয়াল তুলে ঘর বাঁধলাম, তাতে দরোজা আটকে দিলাম। সেই দরোজায় দিলাম খিল। খিলে হলো না, ছিটকিনি আর তালা দিলাম। একতালা, দু’তালা, তিনতলা… তালার ওপরে তালা। তবু হলো না, ডোর-হোল, ডোর-স্টপার সাঁটালাম।
ওদিকে জানালা ঢাকলাম প্রথমে কপাট দিয়ে, তারপর গ্রিল। বারান্দাটুকু ছিলো চাঁদ দেখার, সেখান দিয়েও আসতে পারে ভয়, সেখানেও লোহার গারদ দিলাম।

ঘরের চারপাশে পাঁচিল তুলে, সেই পাঁচিলের ওপর কাঁটা বিছিয়েও যখন হলো না, পাঁচিল থেকে ঘর অব্দি আবার লোহার গারদ দিলাম। ছাদে যাতে কেউ উঠতে না পারে, ছাদ থেকে যেন আসতে না পারে কোনো ভয়, তার বন্দোবস্ত করলাম। লোহার গেটের ওপারে দিলাম কলাপসিবল গেট। ভয়ের বাচ্চা ভয়, কোথা দিয়ে আসবি তুই এবার?

কিন্তু তাতেও হলো না, আমরা দারোয়ান রাখলাম চব্বিশ ঘন্টা। পাড়া মহল্লায় কমিউনিটি সিকিউরিটি বহাল হলো। রাত হলেই মহল্লার গলিপথগুলো বন্ধ করে দিলাম। শুধু বাঁশি আর বাঁশি, লোহার গরাদে দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই।

আর আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ভোট দিলাম, মন্ত্রী বানালাম। তারা আয় অনুপাতে একবার নিলেন ট্যাক্স, তারপর আমাদের কেনাকাটা খাওয়াদাওয়া সবকিছু থেকে নিলেন আরেক দফা ভ্যাট। সে-টাকায় আমাদের নিরাপত্তার জন্য চৌকিদার, আনসার, ভিডিপি, পুলিশ, র্যা ব, গোয়েন্দা, বিজিবি… ম্যালাকিছু হলো, অস্ত্র এলো।

পথে পথে বসলো চেকপোস্ট। যখন তখন আমাকে থামিয়ে, গাড়ি থেকে নামিয়ে তারা হাতিয়ে দিতে থাকলেন। পথে পথে আমি যে একজন নিতান্তই নিরীহ মানুষ তা জবাবদিহিতার বন্দোবস্ত হলো ধমক আর হুমকিতে। পকেটে দুইটা মোবাইল ক্যান, মোবাইল দিয়ে কী করি, কোত্থেকে আসছি কোথায় যাচ্ছি, কেন ওখানে যাচ্ছি বা কেন ওখানে গিয়েছিলাম, সঙ্গে কে? তার সঙ্গে সম্পর্ক কী? কী করি, কেন করি? এতো রাইতে রাস্তায় কেন? ইত্যাকার নানান প্রশ্নবানে জর্জরিত হওয়ার বন্দোবস্ত করেছি নিরাপত্তার দাবীতে।
মেলায় যাবো, দেয় হাতিয়ে। গান শুনতে যাবো, দেয় হাতিয়ে। মার্কেটে যাবো, দেয় হাতিয়ে। সিনেমা দেখতে যাবো, দেয় হাতিয়ে মন খারাপ
অযাচিত স্পর্শে আমার আপত্তি জানানোর সুযোগ নেই। আমাকে নিরাপদ থাকতে হবে।

তাতেও হলো না। আমার নাড়ি নক্ষত্র সব প্রকাশ করতে হবে নিরাপত্তার স্বার্থে। ভাড়াটিয়া হিসেবে ফর্ম পূরণের নামে নিজের সবকিছু উদলা করে দেই।
তাতেও হয় না… ফোনে কথা বলি যে আমরা! কার সঙ্গে কী কথা বলি না বলি সব জানতে হবে। ফোনে পাতো আড়ি… কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে?
ফোনে পাতো আড়ি, ভাইবার নাও কাড়ি, ফেসবুকে কোরো না বাড়াবাড়ি… ব্লগ! মা গো!
সব বন্ধ করে দিয়ে আমরা ভ্রম রুখতে চেষ্টা করি।

তাতেও হয় না, ফোন ব্যবহার করবে? আঙুলের ছাপ দাও… বায়োমেট্রিক পাশ দাও।

তবু হয় না। আমাদের গলির মোড়ে মোড়ে বসে যায় অজস্র সিসিটিভি ক্যামেরা। চব্বিশ ঘন্টার লাইভ টেলিকাস্টে আমি হয়ে যাই অনিচ্ছুক অভিনেতা। আমাকে সারাক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় টিভিতে টিভিতে চেহারা দেখিয়ে যেতে হয়।
আমার নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছাকে আমরা বিসর্জন দেই, আমাদের নিরাপদ থাকতে হবে যে!

চিড়িয়াখানায় থাকা পশুদের চেয়ে আমরা বেশি বন্দী কি না সেই প্রশ্ন এখন আর আমাদের মনে জাগে না। ঘেরাটোপে আমরা এখন নিজেদের এতোটাই বন্দি করেছি যে বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা নিজেরাই আত্মরক্ষার পথ খুঁজে পাই না, ভূমিকম্প হলে পথে নামতে নামতে ভূমিকম্প শেষ হয়ে যায় অনেক আগেই। তবু আমরা ভাবতে ভালোবাসি যে আমাদের নিরাপত্তা দরকার। আর আমার নিরাপত্তার স্বার্থেই তো এতো এতো আয়োজন! বুঝতে হবে, বুঝে ইজি থাকতে হবে।
এই এতোকিছু করে আমরা নিশ্চয়ই এখন নিরাপদ আছি। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ও বলেছেন আমরা নিরাপদে আছি।

যা ঘটছে এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অন্য কোথা অন্য কোনো খানের।
আমরা নিরাপদ আছি, মুক্ত আছি, স্বাধীন আছি, বেঁচে আছি।

[২৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus