বইয়ের নাম মহাবিপদ সংকেত

বইয়ের নাম মহাবিপদ সংকেত

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সামরিক ঘটনাগুলো নিয়ে সকলের আগ্রহ। অনেক রহস্যে আবৃত থাকলেও এ সম্পর্কে তবু কিছুটা লেখালেখি হয়েছে। অনেকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, গবেষণার মাধ্যমে সময়টাকে এখন অনেকটা বোধের নাগালে আনা গেছে। চরিত্রগুলোকে চেনা গেছে।

কিন্তু তখন সামরিক বাহিনীতে যেমন চলছিলো প্রচণ্ড অস্থিরতা, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মরছিলো। ঠিক একই কাণ্ড ঘটছিলো আরেকটি সেক্টরে। দেশের শিক্ষিত কিশোর তরুণ যুবাদের একটা বড় অংশ বিপ্লবের নামে খতমের লাইনে মেতে উঠেছিলো। আর তাদেরকে সেই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিলো একদল রাজনৈতিক নেতা। সেই ভুল বিপ্লবের খেসারত হিসেবে বাংলাদেশের অজস্র তরুণ তাজা প্রাণ ঝরে গেছে সেই সময়ে।

এই সময়টা নিয়ে লেখালেখি খুব বেশি হয়নি বাংলাদেশে। খুব বেশি হয়নি না বলে বলা উচিত ‘একেবারেই হয়নি’। অথচ হওয়াটা ভীষণ জরুরী ছিলো।
বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটি যাতে ভবিষ্যতে একটা লম্বা সময় বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতায় ভোগে, সেজন্য আল বদরদের সহায়তায় পাকিস্তানীরা বেছে বেছে হত্যা করেছিলো আমাদের সেরা সন্তানদের। আর যুদ্ধের পরে যে উদ্যমী তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারতো, সেই মেধাবী প্রজন্মর একটা বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে স্বাধীনতা পরবর্তী ভুল বিপ্লবের বলি হয়ে।

একই কাজ পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে। মূলত তারই রেশ এসে পৌঁছেছিলো বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও বাংলাদেশ যেন ভুলেই যেতে চেয়েছে এই অধ্যায়টি।
সামান্য যেটুকু লেখা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শাহরিয়ার কবির এর ‘ওদের জানিয়ে দাও’। এই বইটি অনেক আগেই পড়া ছিলো, বড্ড প্রিয় বই। কিন্তু পড়া ছিলো না শাহরিয়ার কবিরের গল্পগ্রন্থ ‘মহাবিপদ সংকেত’।

[মহাবিপদ সংকেত, শাহরিয়ার কবির]

মহাবিপদ সংকেত, দূরত্ব, অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ, পিতার শবানুগমন, বেঁচে থাকা… এই পাঁচটি গল্প নিয়ে বইটি। বিদ্যাপ্রকাশের ব্যানারে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত। এই পাঁচটি গল্পে শাহরিয়ার কবির আঁকতে চেষ্টা করেছেন ঐ সময়ের চরিত্রগুলোকে। বিপ্লব যখন খতমের লাইনে হাঁটবে নাকি মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করে ক্ষেত্র তৈরির পথে হাঁটবে এই দ্বিধা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত, পার্টির নির্দেশে নিজ হাতে হত্যা করতে হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে, অস্বীকার করতে হচ্ছে জন্মদাতা পিতাকে… সেই সময়ের গল্পগ্রন্থ ‘মহাবিপদ সংকেত’।

গল্পগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রান্তিক কর্মীদের কথাই উঠে এসেছে। যাঁরা সাম্যবাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলো। কিন্তু তাঁদেরকে যারা ভুল বিপ্লবের দীক্ষা দিলো সেই নেতাদের চরিত্র গল্পগুলোতে তেমন আসেনি। এলে ভালো হতো বেশি। পাঠক সময়টাকে বুঝতে পারতো আরো ভালোভাবে। বা পাশাপাশি ঐ সময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি থাকতো গল্পগুলোতে, তাহলেও পাঠক সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে পারতো। হয়নি।

![](/images/শাহরিয়ার কবির.jpg)

[লেখক শাহরিয়ার কবির]

তবু জাফর, নীনা, মিলন, খোকা, স্বপন, হাসনাত ভাই, খোকন, শেখ আমজাদ আলী, স্বাতী, তাপু, আসিফ, হালিম ভাই, টুকু, রফিক, কামাল, দিপু, মির্জা, ফরহাদ নামের মানুষগুলো পাঠককে নিয়ে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে দ্বন্দ্বমুখর সময়ে। এই যারা আজ আমরা ফেসবুকে বিপ্লব করে ফাটিয়ে ফেলছি, তাঁদের মুখোমুখি দাঁড় করায় হারিয়ে যাওয়া এক উত্তাল সময়কে। ঐ সময়ের মুখোমুখি হওয়াটা এখন আমাদের খুব জরুরী। নিজেকে চেনার জন্য, নিজের ইতিহাসকে জানার জন্য।

নানাবিধ অপ্রাপ্তি সত্ত্বেও তাই এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ। ঐ সময়ের মানুষগুলো এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন। মাথার ওপর রাষ্ট্রীয় হুলিয়া আর দলীয় খতমের আদেশ নিয়েও যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের স্মৃতিকথাগুলো ধরে রাখা খুব জরুরী। তালে হয়তো আজকের বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের হতাশার জবাবগুলো পাওয়া যাবে।

[বই কৃতজ্ঞতা: দূর্লভ নিবরাস আহমেদ]

[১৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus