বর্ণালী সাহার নর্থ এন্ড

বর্ণালী সাহার নর্থ এন্ড

বর্ণালী সাহা কিংবা তাঁর লেখালেখির সঙ্গে সামান্যতম পূর্ব পরিচয়ও ছিলো না। কিন্তু বইমেলার সময়ে এমন কজন বন্ধু ‘দ্য নর্থ এন্ড’ উপন্যাসটার কথা প্রচার করলেন, যাঁদের পাঠে আমার ভক্তি আছে। সেই সুবাদেই আগ্রহ তৈরি হলো। আর কেনা হলো Monika Muna-র সৌজন্যে। প্রচ্ছদটাও নজর কাড়লো, যদিও প্রচ্ছদ কার করা তা জানা গেলো না। ফ্ল্যাপে Shibu Kumer Shill-এর লেখাটুকু আগ্রহ উসকে দিলো আরো একটু। জানা গেলো লেখক মূলত গানের লোক, তায় আবার রাগ সঙ্গীতের। গানের লোকদের বেলায় আমার বরাবরই একটা আলাদা সমীহ আছে, থাকে। বই পড়ার আগেই ফেসবুক সূত্রে বর্ণালী সাহার সঙ্গীত রুচির যৎসামান্য যা জানা হলো, তাতে মুগ্ধতা বাড়লোই।

নিশ্চিত পছন্দের লেখকদের লেখা না হলে এখন আর ফিকশন পড়া হয় না। অচেনা (আমার বেলায়) লেখকের বই তাই খুব সাবধানে পড়ি, উপরের এতোগুলো মুগ্ধতা-সমীহতা-কৌতুহলতা সব দূরে রেখে আপাতত পড়তে বসি ‘দ্য নর্থ এন্ড’। বর্ণালী সাহা লিখেছেন উত্তম পুরুষে (নারীর উত্তম হবার জো নেই বাংলা ব্যাকরণে)। কৌতুহল আরো একটু বাড়লো, এমনটা আজকাল লেখেন না অনেকে। শুরুর বাক্য থেকেই লেখায় চেনা রাস্তায় হাঁটার মতো একটা গতি আছে, ভাষায় অতিথি পাঠকের জন্য সমাদর আছে। খুব অনায়াসেই পাঠককে আপন করে নিতে পারে, দুর্বোধ্যতা দূরে সরিয়ে রাখে না।

আমরা একজন নারীকে জানতে পারি, যার নাম জানা হয় না। পড়তে পড়তে মনে হয় লেখক বুঝি তাঁর নিজের কথাই বলছেন। যে নারী একজন এনজিও-কর্মী, সদ্য অতীতে কাজ করছিলেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে। কর্মসূত্রেই পরিচয়, বন্ধুত্ব এবং প্রেম হয় ডেনিশের সঙ্গে। লোকটার নাম ডেনিশ, নাকি ডেনমার্কের অধিবাসী বলে লেখক তাকে ডেনিশ বলছেন বুঝতে পারি না। যাহোক, ডেনিশ ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। প্রেমের সূত্রেই নারী অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডেনমার্কে যেতে চান। এই সম্পর্কের ব্যাপারটা আপাতত গোপন, বিদেশ যাত্রার তথ্যটাও। কিন্তু ডেনমার্কে যাওয়ার জন্য বেশ বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন, সেটুকুর বন্দোবস্তের জন্য প্রাণের বন্ধু রাহাতের আগমন।

১২০ পাতার উপন্যাসটা মূলত এই দুই বন্ধুর একটা দিন আর দিবাগত রাত যাপনের গল্পই। বনানীর পূজা মণ্ডপ থেকে তারা যায় রাস্তায়, রাহাতের নতুন দামী গাড়িতে চড়ে যমুনা ফিউচার পার্কের দিকে যেতে যেতে নারী বলে নিজের ভবিষ্যতের কথা, নতুন প্রেমের কথা। যে জ্ঞান রাহাতকে কোনো নতুন প্রতিক্রিয়া দেয় না। উল্টো খুব অদ্ভুতভাবে রাহাত শাওনের কথাই জিজ্ঞেস করে, জিজ্ঞেস করে বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান আছে কি না! উল্লেখ্য শাওন এই নারীর বর্তমান স্বামী, যিনি আবার ডাক্তার। প্রাণের বন্ধু রাহাতের এই আচরণ নারীকে হতাশ করে। ”রাহাতের পাশে সেই বসে থাকার সময়টুকুকে আমি অনেক পরে চোখের সামনে ছবির মতো ধরে পর্যবেক্ষণ করেছি। মনোযোগ-পিয়াসী কোনো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গকে যেকোনো কারণেই হোক মনোযোগের জোগান না-দেওয়ার মধ্যে একটা কোমল ক্যালকুলেটেড নিষ্ঠুরতা আছে। মনে হচ্ছিল রাহাত যেন আমাকে সমগ্র জগতের হয়ে শাস্তি দিচ্ছে। লাগাতার এইরকম শাস্তি দিতে দিতে গোষ্ঠীর লোকেরা এবং দলবদ্ধ বন্ধুরা ব্যক্তির অন্তর্গত বিশ্বাসকে ভাঙে। ব্যক্তিকে নমনীয় করার নাম করে তাকে ভঙ্গুর করে। তারপর তার অন্তরের-ভিতরকার-অন্তর থেকে এই স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয় যে, নিশ্চয়ই একটা ভয়ানক শাস্তিযোগ্য কাজই সে করেছে। বাবা-মা, স্কুলের শিক্ষক, সামাজিক গুরুজন- সকলের সিক্রেট ফর্মুলা তো এমনই। সবচেয়ে ভয়ংকর কারা? সবচেয়ে ডেঞ্জারাস হচ্ছি আমরা পুরানো বন্ধুরা। আমরা যারা অন্তরের বন্ধু, অর্থাৎ আত্মার ভিতরে ঘটে যাওয়া প্রভূত মৃত্যু, ঘাত-প্রতিঘাত, যুদ্ধ-সন্ধি, যাবতীয় সংগ্রামের ঐতিহাসিক সাথী, সেই আমরা তো বন্ধুর মুখ দিয়ে এমনকি এইটাও কবুল করিয়ে নেই যে এমনে মাথা পেতে শাস্তি গ্রহণ করাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈপ্লবিক, সবচেয়ে র‌্যাডিকাল কীর্তি। এই পুরা ঘটনাটাই ঘটে তীব্র ভালোবাসা বা মমত্ববোধ, আর তার সাথে মিশে থাকা ক্যাজুয়াল একটা অবহেলার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘গ্রহণ-বর্জন’ না। এর নাম হলো গ্রহণ-খারিজ। এইভাবে গ্রহণ-খারিজ-গ্রহণ-খারিজ-গ্রহণ-খারিজ-বুক পেতে গ্রহণ-খারিজ-গ্রহণ-তীব্র খারিজ-মোটামুটি গ্রহণ-খারিজ… অ্যাড ইনফিনিটাম।”


[লেখক বর্ণালী সাহা]

বন্ধুত্বের শাস্তিটা তীব্র হয়ে আসে উপন্যাসের শেষে। ডেনমার্ক যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ১০ লাখ টাকা যখন বিভিন্ন ডামাডোলের মাধ্যমে একসময় রাহাত জোগাড় করে দেয়, তখন নারীর মনে হয় ”শাওন কি এসব জানে? জানে নিশ্চয়ই-নইলে হিরোর সাথে গাড়িতে ওঠার পর কে রাহাতকে সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছিল? সন্ধ্যায় ওষুধ কম্পানির হিরো আর রাহাতের মধ্যস্থতায় যেই দশ লাখ টাকা আমি এই স্যুটকেসে পুরেছিলাম, তা শাওনের সুবাদে প্রাপ্ত কি? বেচাবিক্রির স্বার্থে হিরো আর রাহাত কি সেই টাকা ডাক্তার শাওনকেই দিলো, আমাকে না? আহা, শাওন কি তবে আমাকে দয়া দেখাল? চ্যারিটি করল?”

চ্যারিটি এই উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ডেনিশের নানি বা দাদী প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা রোজম্যারি ইম্যাকুলেট, যাঁকে কেউ না কেউ প্রায় প্রতিদিনই ফোন করত। বলত ইয়েমেনের স্কুলে বাচ্চাদের ওপর শিলাবৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণের গল্প, বলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। কী করবেন রোজম্যারি? কতজন মানুষের দুঃখ লাঘব করবেন? মর্নিংওয়াকে গিয়ে একদিন ব্রিস্টলের ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে তিনি লাফিয়ে পড়েন। (এই পরিচয়টা ফ্ল্যাপ থেকে মেরে দিলাম)

তখন আমাদের মনে হয়, উপন্যাসে বর্ণিত যে নারী, সেও একজন শরণার্থীই আসলে। কক্সবাজার থেকে এই চেনা পরিচিত ঢাকা শহরে সে লুকিয়ে আছে। ১০ দিনের জন্য আশ্রয় নিয়ে আছে একটা শুটিং হাউজে। যেথায় আপাতত শুটিং নাই। কিন্তু ভাড়া নেওয়ার পরেও যেথায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না, ঘরে ঢুকে পড়ে অন্যলোক, চাবি ডুপ্লিকেট। যেই বাড়িতে নিজেকে তার ছিন্নমূল মনে হয়। এবং লক্ষ্যণীয় এই বাড়িভাড়া তাকে নিতে হইছে ভারতীয় ছদ্মবেশে। এবং উপন্যাসের শেষে সেই ভোর রাত্তিরে ‘খোলিয়ে, খোলিয়ে, খোলিয়ে’ চিৎকারেও যে বাড়ির দরোজা আদৌ খোলে কি না তা আমরা জানি না। সেই নারীকে চ্যারিটি করে দেয় প্রাণের বন্ধু রাহাত, কিংবা পূর্বের স্বামী শাওন। যার হয়ে সস্ত্রীক রাহাতের দুই জোড়া জাগ্রত চোখ কালো গাড়ির ভিতর থেকেও স্থির উঁকি দিয়ে থাকে ’নারী’র বাড়ির ভিতর ঢুকে যাওয়ার অপেক্ষায়…!

যেভাবে সমগ্র বাংলাদেশে নর্থ এন্ড ক্যাফের ৯টা শাখার মধ্যে ৮টাই ঢাকায় আর অপর ১টা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে, কক্সবাজার ছাড়িয়ে একেবারে উখিয়ার মোহরিপাড়ায়… যে উখিয়া শরণার্থীদের জন্য প্রায় একটা যাবজ্জীবন দণ্ডের নাম হওয়া সত্ত্বেও এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত শাদা এক অভয়ারণ্য হয়ে… তেমনি শরণার্থী নারীর যাবজ্জীবন দণ্ডের পটভূমিতে আপাত স্বজন বন্ধুত্বের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার স্বরূপটা আমরা দেখতে পাই বর্ণালী সাহার ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ উপন্যাসে। এতবিধ জানতে জানতে কফির মতো আমাদের মনটাও তিতা হয়ে যায়…

[০৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত]

comments powered by Disqus