বিষাদের সিন্ধু থেকে বিন্দু, মার্সিয়া কান্নার নতুন রূপ

বিষাদের সিন্ধু থেকে বিন্দু, মার্সিয়া কান্নার নতুন রূপ

১.
সংসারের সমস্ত ক্লান্তির শেষে মোটা একটি বই থেকে মৃদুস্বরে একটানা ঘ্যানঘ্যানে সুরে আম্মা একমনে পড়ে যেতেন দাস্তান শহীদে কারবালা। পয়ার ছন্দের জাদুকরী একঘেয়ে সুরের বোররাকে চড়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো মার্সিয়া ক্রন্দন। ছোটবেলা থেকে দেখা এ দৃশ্য মোহিত করতো। যতদূর মনে পড়ে আম্মা যখন মার্কিন সাম্রাজ্যে প্রবাসী হন, খুব যত্ন করে বইটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই পুঁথি পরে আর অনেক খুঁজেও কোথাও থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি। কিন্তু এখনো কানে বাজে সেই মিহি সুর-

যখন বসিল কাফির ছাতির উপরে।
ছের জুদা কৈল যদি ইমামের তরে।।
আরস কোরস লওহ কলম সহিতে।
বেহেস্ত দোজখ আদি লাগিল কাঁদিতে।।
আসমান জমিন আদি পাহাড় বাগান।
কাঁপিয়া অস্থির হইল কারবালা ময়দান।।
আফতাব-মাহতাব তারা কালা হইয়া গেল।
জানওয়ার হরিণ পাখি কাঁদিতে লাগিল।।
বালক মায়ের দুধ না খায় শোকেতে।
নাওমেদ রহে সবে এনাম জুদায়েতে।।
বাঘ-ভাল্লুক কাঁদে আর মহিষ-গণ্ডার।
বাচ্চারে না দেয় দুধ কাঁদে জারে জার।।
গাই নাহি দুধ দেয় বাছুর লাগিয়া।
বাছুর না খায় কিছু দেলে শোক পাইয়া।।
মৌমাছি ভ্রোমর কাঁদে হইয়া উধাও।
কাঁকে কুম করে কাঁদে গৃহস্তের বউ।।

[বিষাদ বিন্দু: শামিম আহমেদ]

২.

[আব্বাস আল-মুসাভি - কারবালার যুদ্ধ - ব্রুকলিন জাদুঘর]

কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেন আর তার পরিবারের বিয়োগান্তক কাহিনী নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কাব্যই লেখা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় ধারা এই মার্সিয়া সাহিত্য। বঙ্গে ইসলাম প্রচার আর জনপ্রিয়করণেও মার্সিয়া সাহিত্যের অবদান আছে। সুন্নী অধ্যূষিত হলেও বাঙালি মুসলমানের মনে কারবালার শোক একটি বড় জায়গা করে নিতে পেরেছে। আশির দশক পর্যন্তও এই বাংলার ঘরে ঘরে সঞ্চয়িতা, গীতবিতান, শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন আর শ্রীকান্ত থাকতো আর দেয়ালে অবধারিতভাবে ঝুলতো সস্তা আর্টের বিকৃত চেহারার রবিঠাকুর, কাজী নজরুল আর বর্শাবিদ্ধ দুলদুল ঘোড়ার ছবি। এই দুলদুল ঘোড়ার ছবির আবার ছিলো নানান বৈচিত্র। খুবই রূপবতী করতে সেই ঘোড়ার মুখ কখনো হয়ে যেতো সুন্দরী নারীর, এবং তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝতে পারি সেই নারীর চেহারার সঙ্গে মিলে যেতো দূর্গা প্রতিমার রূপ… গ্রামীণ আঁকিয়েদের কী মহিমা!

বলা হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম মার্সিয়া কাব্য শেখ ফয়জুল্লাহর লেখা ‘জয়নবের চৌতিশা (১৫৪৫ খ্রি:)। তবে বাংলায় মার্সিয়া সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কবি দৌলত উজির বহরম খাঁর ‘জঙ্গনামা পুঁথি’। চট্টগ্রামেরই আরেক কবি মুহম্মদ খানের ‘মকতুল হোসেন’ও গুরুত্বপূর্ণ। হোসেন পুত্র কাশেমের বীরত্ব এবং সখিনার বিলাপ নিয়ে শেখ শেরবাজ চৌধুরী আলাদা করে লিখেছেন ‘কাসেমের লড়াই’। ১৮ শতকে কবি জাফরও লিখেছেন ‘সখিনার বিলাপ’। হেয়াত মাহমুদ লিখেছেন ‘জঙ্গনামা’। হামিদ কবি লিখেছেন ‘সংগ্রাম হুসন’। এগুলো সবই মোঘল আমলের সাহিত্য।

ইংরেজ আমলে ফকির গরীবুল্লাহ লেখেন ‘জঙ্গনামা’ (১৭৯৪)। এসময় সনাতন ধর্মীয় কবি রাধারচণ গোপ লেখেন ‘ইমাম হোসেনের কেচ্ছা ও আফৎনামা’। খান বাহাদুর মুহম্মদ হামিদুল্লাহ লেখেন ‘গুলজার-ই-শাহাদৎ বা শাহাদতুদ্যান’ (১৮৬৩)। মীর মনোহার লেখেন ‘হানিফার লড়াই’ (১৮৮৬)। সুনামগঞ্জের ওয়াহেদ আলী লেখেন ‘বড় জঙ্গনামা’। ইসহাক উদ্দীন লেখেন ‘দাস্তান শহীদ-ই-কারবালা’। চট্টগ্রামের কাজী আমিনুল হক লেখেন ‘জঙ্গে কারবালা’ (১৯৪৫), আবুল আলী মোহাম্মদ হামিদ আলী লেখেন ‘কাসেম বধ কাব্য’ (১৯০৬) ও ‘জয়নাল উদ্ধার’ (১৯০৯)। মোহাম্মদ উদ্দীন আহমদ লেখেন ‘মোহররম কাব্য’ (১৯১২), মোহাম্মদ আব্দুল বারী লেখেন ‘কারবালা (১৯১২৩), কবি কাজেম আল কোরাইশী ওরফে কায়কোবাদ লেখেন ‘মহরম শরীফ’, ফজলুর রহিম চৌধুরী লেখেন ‘মহরম চিত্র’ (১৯১৭)। গোলাম সাকলায়েন লেখেন ‘কারবালার কাহিনী’, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ লেখেন ‘কারবালার যুদ্ধ ও নবী বংশের ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৭)।

এর মধ্যে ‘দাস্তান শহীদ-ই-কারবালা’ ছাড়া কোনোটাই পড়িনি বা পড়ার সুযোগ হয়নি। তবে কারবালার কাহিনী নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়েছি। হাসান হোসেনের কাহিনী বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে ‘বিষাদ সিন্ধু’র অবদানই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি।

বাংলার আরেকটা জনপ্রিয় পুঁথি মুন্সী আব্দুল করিমের ‘সোনাভানের পুঁথি’। নাগরী লিপিতে লেখা এই পুঁথি বাংলা ভাষাতেও তর্জমা হয়েছে। গ্রাম বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় পুঁথি এটা। যদিও সোনাভানের পুঁথি ঠিক কারবালার ইতিহাস নিয়ে না। হাসান হোসেনের বৈমাত্রেয় ভাই হানিফার কাহিনী।

হানিফার মা খাওলাহ বিনতে জাফরের প্রথম স্বামী মহসিন বিন সলমন উহুদের যুদ্ধে শহীদ হলে দ্বিতীয় বিয়ে হয় সুফিয়ান বিন সাখরের সঙ্গে। তার মৃত্যুর পর তৃতীয়বার বিয়ে হয় হজরত আলীর সঙ্গে। সেই ঘরের সন্তান হানিফা। হানিফার জন্মের পর আলী খাওলাহকে তালাক দিলে তিনি মদিনা থেকে মাজুনে ফিরে যান। হাসান হোসেনের মৃত্যুর পর কেউ কেউ হানিফাকে খলিফা বানানোর চেষ্টা করে। মুখতার আল সাকাফি সিমারসহ হোসেন হত্যাকারীদের ধরে ধরে হত্যা করতে থাকেন এবং দাবী করতে থাকেন হানিফাকে খলিফা বানানোর।

আগেই বলেছি, সোনাভানের পুথি কারবালার কাহিনী না। ঢাকার উপকণ্ঠে টঙ্গীতে ছিলো সোনাভানের রাজত্ব। তিনি শিব ও কালীর পূজারি ছিলেন। ছিলেন বীরনারী। মুন্সী আব্দুল করিম বর্ণনা করেন আলীপুত্র হানিফা আরবে বসে সোনাভানের বীরত্বের কাহিনী শুনে তাকে শায়েস্তা ও বিয়ে করতে স্বপ্নাদিষ্ট হলেন। এবং ৬ মাসের পথ মাত্র ৬ দিনে পারি দিয়ে টঙ্গীতে এসে পৌঁছালেন। সেখানে এক বুড়ির মারফত সোনাভানকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। সোনাভান বুড়িকে মেরে তাড়ালেন। শুনে হানিফা ক্ষুব্ধ হয়ে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধে হানিফার পরাজয় হলো। সোনাভান তাকে শিব ও জয়কালীর পদতলে নরবলি দিতে নিয়ে গেলেন। কিন্তু হজরত আলীর ভয়ে দেবতারা নরবলি গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। বিবি ফাতিমা স্বপ্নে এই ঘটনা জানতে পেরে হজরত আলীকে জানালে আলী উদ্ধার করলেন হানিফাকে। কিছুদিন পর আবার হানিফা এসে সোনাভানের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। এবারো সুবিধে হলো না। সোনাভান হানিফাকে একটা সিন্ধুকে ভরে ভাসিয়ে দেয় কহর দরিয়ায়। কিন্তু হানিফাকে এবার রক্ষা করলো খোয়াজ খিজির। হানিফার পক্ষ হয়ে যুদ্ধে নামলেন তার তিন স্ত্রী মলিকা, জয়গুন আর সমর্থভান। এবার সোনাভানের পরাজয় হলো। পরাজিত সোনাভানকে বিয়ে করে মদীনায় নিয়ে গেলেন হানিফা।

আদতে সোনাভানের অস্তিত্ব ছিলো কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত জানা যায় না। টঙ্গী বাজারের পশ্চিমে বর্তমানে যেখানে হাজী সাহেবের মাজার, সেটাই নাকি সোনাভানের ভিটে ছিলো। আর এখন যেখানে টঙ্গী কলেজ, সেটা ছিলো সোনাভানের বাগানবাড়ি। কথিত আছে সোনাভান তার ধন সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন বটগাছের নিচে সুড়ঙ্গ বানিয়ে। ভাওয়াল রাজা সেই গুপ্তধন উদ্ধার করে তা দিয়ে নতুন জমিদারী কিনেছিলেন। কিন্তু আরব দেশ থেকে হানিফার বঙ্গদেশে আগমন, যুদ্ধ এবং বিবাহ অতিকল্পনাই মনে হয়। এই কল্পনার সূত্র কোথায় জানা নেই।

এখানে খোয়াজ খিজিরের প্রসঙ্গও ইন্টারেস্টিং। আবে হায়াত পানকারী খোয়াজ খিজিরকে নিয়ে বাংলায় রচিত হয়েছে অসংখ্য জারিগান। ছোটবেলায় শোনা ‘খোয়াজ খিজির ও লক্ষমোতীর জারি’র কথা মনে পড়ে। নব্বই দশকেও ৩৫ টাকা দামের ক্যাসেটে প্রচুর শুনেছি। জয়গুন বিবির কিচ্ছাও বেশ জনপ্রিয় ছিলো। কারবালার কাহিনী নিয়ে অসংখ্য যাত্রাপালাও হতো একসময় সারাদেশে। এখন হয় কি না জানা নেই।

৩.

বাংলায় কারবালার একটাই ইতিহাস। একটাই বয়ান। মুঘল আমল থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সবাই মূলত একটাই ইতিহাস লিখে গেছেন। সে ইতিহাস হাসান হোসেনের, সে ইতিহাস করুণ, একপাক্ষিক, একতরফা। এখানে মুয়াবিয়াপুত্র এজিদ হচ্ছেন ভীলেন, কাফের, শয়তান। বিশ্বের অন্য কোনো ভাষায় এর ব্যাতিক্রম আছে কি না তা আমার জানা নেই।

[লেখক শামীম আহমদ]

কলকাতার লেখক শামিম আহমদ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন ভিন্ন এক এজিদকে, জানতে চেষ্টা করেছেন কারবালার ইতিহাসের নতুন পাঠ। তাঁর সেই চেষ্টার নামই ‘বিষাদবিন্দু’। শত শত বছর ধরে রচিত বিশাল বিশাল কাব্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন মাত্র ১১৯ পাতার এক ছোট্ট বই। সিন্ধুর বিপরীতে বিন্দুর মতোই।

বাতিঘর তখনো ঢাকায় শোরুম খোলেনি, চট্টগ্রামেই একমাত্র। আমার সৌভাগ্য যে বাতিঘরে ভালো কোনো বই এলে কর্ণধার দীপঙ্করদা আমাকে জানাতেন শুধু না, কুরিয়ার করে একেবারে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন বই। এখনো দেন। এই সেদিনও একগাদা বই পাঠিয়ে ঋণী করলেন।
দীপঙ্করদাই একদিন জানালেন ‘বিষাদবিন্দু’ নামে একটি ভালো বই এসেছে, আমার লাগবে কি না। কোন ধরণের বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ, তা তিনি খুব জানেন। তাই লেখক আর বই দুটোই অপরিচিত হওয়ার পরেও নির্দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতে বলেছিলাম। সেই সুবাদেই পড়া হয়েছিলো দারুণ এই উপন্যাসটি।
বইটি প্রকাশ করেছে কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স। মূল্য ১৫০ রুপী।

৪.
উপন্যাসের পটভূমি সপ্তম শতাব্দীর সিরিয়া। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে ৬৪৭ থেকে ৬৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠিত হয় খিলাফায়ে রাশিদিন। প্রথম খলিফা কে হবেন তা নিয়ে বিরোধ ছিলো। শেষ পর্যন্ত আবু বকর (রাঃ)কে খলিফা মনোনীত করা হয়। তিনিই পরবর্তী খলিফা ওমর (রাঃ)কে নির্বাচন করে যান। তৃতীয় খলিফা ওসমান (রাঃ)র অপঘাতে মৃত্যুর পর খিলাফতের দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নেয় হজরত আলী (রাঃ) এবং হজরত মুয়াবীয়া (রাঃ)র মধ্যে। মীমাংসা হয় আলীর মৃত্যুর পর মুয়াবীয়া হবেন খলিফা। আলী রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করেন। ৪০ হিজরী সালে চতুর্থ খলিফা আলীর মৃত্যুর পর মুয়াবীয়া খলিফার দায়িত্ব পান। মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া গোত্রের দ্বিতীয় খলিফা, প্রথমজন ছিলেন ওসমান ইবনে আফফান। খুলাফায়ে রাশেদীনের পর মূলত মুয়াবিয়ার হাত ধরেই উমাইয়া খিলাফতের শুরু হয়। তিনি রাজধানী সরিয়ে নেন দামেস্কে। ইসলামের খলিফা হিসেবে মুয়াবীয়ার সময়কাল ছিলো ২০ বছর। হিজরী ৬০ সনের ২২ রজব বৃহস্পতিবার মুয়াবিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি পুত্র এজিদকে খলিফা পদে মনোনয়ন দিয়ে গেলেও তখন আরো অনেকেই খিলাফতের দাবীদার ছিলেন। আলীপুত্র ঈমাম হাসান ততোদিনে নিহত। ঈমাম হোসেন ছিলেন প্রধান দাবীদার। এছাড়া আবু বকর (রাঃ)র পুত্র আবদুর রহমানও খিলাফতের দাবীদার। খিলাফতের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দাবীদার ইসলামের ইতিহাসে জন্মসূত্রে প্রথম মুসলমান, প্রথম খলিফা আবু বকরের কন্যা আসমার ছেলে, বিবি আয়েশার ভাগ্নে আবদুল্লাহ বিন জুবাইর। উল্লেখ্য এজিদ এদের মধ্যে বয়সের হিসেবে সর্বকনিষ্ঠ। বাকি সবাই মহানবীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেলেও এজিদের জন্ম মহানবীর ওফাতেরও ১৫ বছর পরে।

হিজরী ২৬ সনে এজিদের জন্ম হয়। এজিদের মা মাইসুন বিনতে বাইদাল আল কুলাইবি আন-নাসরানিয়া। তিনি ছিলেন নাসারা অর্থাৎ খ্রীস্টান। জাতিতে ছিলেন বেদুঈন। আর তিনি ছিলেন একজন কবি।
এজিদের জন্মের আগেই মুয়াবীয়া তালাক দিয়েছিলেন মাইসুন বিবিকে। তিনি থাকতেন বেদায়ি নামের এক জায়গায়। সেখানেই জন্ম হয় এজিদের, এজিদ ইবনে মুয়াবীয়া ইবনে আবু সুফিয়ান। এজিদ নামের অর্থ ‘যে মহান হতে চলেছে’। পিতার সংস্পর্ষ ছাড়াই এজিদ বড় হতে থাকে। মায়ের কবিতা পড়ে, মায়ের গান শোনে, নিজেও ড্রাম, রেবাব (বেহালা) আর ওউদ (গিটার) বাজায়। মায়ের কাছে শেখে নসব, সনদ আর রুকবানি রাগ।

শামিম আহমেদ লিখেছেন মায়ের কাছে এজিদ আফলাতুনের গল্পও শুনেছেন। অবশ্যই এটা লেখকের কল্পনা। কিন্তু এখানে গ্রীক দার্শনিক প্লাটোর কোরানিক নাম আফলাতুনকে টেনে আনার ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং।

যাহোক, ১৭ বছর বয়সে এজিদ দামেস্কে এসে হাজির হয় পিতার খোঁজে। মুয়াবীয়ার অন্য কোনো পুত্র না থাকায় এজিদকে পুত্ররূপে গ্রহণ করা হয়। নবী মুহাম্মদের ঘণিষ্ঠ সাহাবা মুয়াবীয়ার পুত্র এজিদ দিনে দিনে দূর্বিণীত হয়ে ওঠে। সারাদিনরাত পান ভোজন, সঙ্গীত, কাব্য আর পশুপাখি নিয়ে মত্ত হয়ে ওঠে। আর মত্ত হয় বালক-প্রেমে।

এই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। এজিদের সমকামীতার কথা অনেক জায়গাতেই উল্লেখ আছে, শামিম আহমেদও লিখেছেন। যদিও এজিদের নারীপ্রীতির কথাই বেশি বলা হয়। এজিদের ৩ স্ত্রী এবং ৪ সন্তান রয়েছে। দাসীদের গর্ভেও এজিদের সন্তানাদী আছে। এজিদের প্রথম স্ত্রী উম্মে হিশাম, দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুম। এই দুই স্ত্রীর ঘরে এজিদের তিন পুত্র- মুয়াবীয়া বিন এজিদ, খালিদ আর আবদুল্লাহ। জয়নবের প্রতি প্রেম থেকেই ঈমাম হাসানের সঙ্গে এজিদের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত হয়। ষড়যন্ত্র করে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ঈমাম হাসানকে। আর কুসতান্তিনিয়া অর্থাৎ কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধে গিয়ে প্রেম হয় আনাতোলিয়ার রাজকুমারী ঘাসানিয়া রাজবংশের মেয়ে বিন জাবালার সঙ্গে। সেখানেই বিয়ে হয় বাবেলের রাজকন্যা উম্মে রামালার সঙ্গেও। সে ঘরে আছে একমাত্র কন্যা বিলকিস।

যাহোক, কুসতান্তিনিয়া বিজয় হয়ে ওঠে না এজিদের। যোদ্ধা বা বীরত্বের কোনো ইতিহাস এজিদের নেই। যদিও তার দাদা আবু সুফিয়ান ছিলেন কোরাইশ বংশের দুর্ধর্ষ গোষ্ঠীপতি। মুয়াবীয়ার নানা উৎবাও ছিলেন নামকরা বীর। মুয়াবীয়ার মায়ের নাম হিন্দ। কথিত আছে উহুদের যুদ্ধে তিনি নবীজীর চাচা হামজার কলিজা বের করে খেয়েছিলেন!

হিজরী ৬০ সালে মুয়াবীয়ার মৃত্যু হলে মুসলিম জাহানের ষষ্ঠ খলিফা হিসেবে শপথ নেন এজিদ। মদিনায় এ খবর পৌঁছালে আবু বকরের পুত্র আবদুর রহমান তা মানতে অস্বীকার করেন। আবদুল্লাহ বিন জুবাইর ঈমাম হোসেনকে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলেন। তিনি ছিলেন মক্কার শাসনকর্তা। মক্কা থেকে সামরিক সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দেন। বিন জুবাইর ইরাক, দক্ষিণ আরব ও সিরিয়ার একটা বড় অংশ নিজের দখলে রাখলেন। মিশরের যে গুপ্তবাহিনী খলিফা ওসমানকে হত্যা করেছিলো, তারাও বিন জুবাইরের পক্ষে রইলো। হোসেন মদীনায় অবস্থান নিলেন।

কুফা নগরী এজিদের দখলে থাকলেও দৃশ্যত সেখানে হোসেনের জনপ্রিয়তা বেশি ছিলো। কুফাবাসীরা হোসেনকে তাদের মাঝে পেতে চাইলে হোসেন মদীনা থেকে মাত্র ৭২ জন পুরুষ এবং কয়েকজন নারী ও শিশুকে নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। আবদুল্লাহ বিন ওমর, আবদুল্লাহ বিন জুবাইর এবং আবদুল্লাহ বিন আব্বাস সহ অনেকেই হোসেনকে কুফা যেতে নিষেধ করেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন অন্তত নারী ও শিশুদের সঙ্গে না নিতে। কিন্তু হোসেন একক সিদ্ধান্তে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এজিদের নির্দেশে হুর বিন রিহায়ির নেতৃত্বে ১ হাজার সৈন্যের একটি দল কারবালার প্রান্তরে হোসেন বাহিনীর পথ রোধ করে।

[গুগল ম্যাপে মক্কা, মদীনা, কুফা ও কারবালার অবস্থান]

গুগল ম্যাপ চেক করে দেখলাম মদীনা থেকে কারবালার অবস্থান কুফার চেয়েও প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে। হোসেন কেন এতোটা ঘুরপথে যাচ্ছিলেন তা ভেবে অবাক হলাম। অন্য আরেকটি তথ্যে জানা যায় অগ্রবর্তী মুসলিম বিন আকীল চিঠি লিখে হোসেনকে কুফায় আসতে নিষেধ করায় হোসেন কুফার পথ ত্যাগ করে সরাসরি দামেষ্কে এজিদের কাছেই যাচ্ছিলেন। কেবলমাত্র এ তথ্য সত্য হলেই কারবালায় হোসেনের অবস্থানের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়। শামিম আহমেদ সম্ভবত এই ব্যাপারটি মিস করে গেছেন।

যাহোক, বাধা পেয়ে মহররমের ২ তারিখে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে তাঁবু খাটায় হোসেনের কাফেলা। ততোক্ষণে এজিদের বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে ৮০ হাজার সৈন্য। বিন সাদের নেতৃত্বে সে বাহিনী হোসেনের বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে রাখে যাতে তারা খাবার বা পানি না পায়। অবরোধ চলে ৭ দিন। কিন্তু কুফা বা মক্কা থেকে হোসেনের সাহায্যার্থে কেউ এগিয়ে আসেনা। মহরমের ১০ তারিখ ভোরে শুরু হয় চূড়ান্ত যুদ্ধ। হোসেনের বাহিনীতে মাত্র ৩২ জন ঘোরসওয়ার আর ৪০ জন পদাতিক সৈন্য। যদিও ইতিহাসে প্রচলিত আছে রাহাব দত্তর নেতৃত্বে একদল ব্রাম্মণ এই যুদ্ধে হোসেনের বাহিনীতে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু শামিম আহমদের বইতে তার উল্লেখ পাই না। স্বল্পশক্তির কারনে অবধারিতভাবেই পরাজয় হয় হোসেন বাহিনীর। নিহত হন ঈমাম হোসেন। তাঁর দুলদুল ঘোড়া হারিয়ে যায় ফোরাতের পথ ধরে। যে ঘোড়াটি হারিস নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে নবীজী নিজে উপহার দিয়েছিলেন হোসেনকে। যার আরেক নাম জুলজানাহ আর আসল নাম মুর্তাজিজ। যে ঘোড়া প্রতীক হয়ে আছে কারবালার।

কথিত আছে ঈমাম হোসেনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে এজিদ দুঃখ পেয়েছিলেন। ব্যাপারটা অনেকটা খালেদ মোশাররফের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে জিয়ার দুঃখ পাওয়ার মতো।

কারবালার পরেও এজিদ আরো ৩ বছর ৯ মাস খলিফা ছিলেন। মুসলিম জাহানে তিনিই প্রথম খলিফা, যিনি বংশানুক্রমে মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিলো তা নিয়ে রহস্য আছে। এজিদের মৃত্যুর পর খলিফা হন তারই সন্তান মুয়াবিয়া বিন এজিদ। উমাইয়া খিলাফত টিকে থাকে ১০৩১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। যদিও এর মধ্যে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসীয় খিলাফত।

এজিদের পরম্পরাই সম্ভবত বর্তমান ইরাকে ইয়াজিদি কুর্দি হিসেবে পরিচিত। যে সম্প্রদায় থেকে ২০১৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান নাদিয়া মুরাদ।


[নাদিয়া মুরাদ]

৫.
শামিম আহমেদ কি বিষাদবিন্দুতে কোনো নতুন গল্প বলেছেন? এজিদকে নায়ক বানাতে চেয়েছেন? তেমনটি চোখে পড়েনি। বড়জোর তিনি প্রচলিত ইতিহাসের ভীত না নাড়িয়ে কাফের এজিদকে দেখতে চেয়েছেন মানুষের রূপে। যার হৃদয়ে প্রেম আছে, সঙ্গীত আর কাব্য আছে। রবিঠাকুরের ভাষায় ‘ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি’। বরঞ্চ প্রচলিত অনেক মিথকেই শামিম উপন্যাসে ঠাঁই দিয়েছেন, হয়তো আবেগের মশলা হাতছাড়া করতে চাননি বলে।

তবে শত শত বছরের চেনা ইতিহাসের বাইরে কিছু নতুন প্রশ্ন পাঠকের মনে তৈরি হয়, যে পথ ধরে এগিয়ে গেলে নতুন কিছুর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অনেকে তো কারবালার সম্পূর্ণ ঘটনাকেই উড়িয়ে দেন মিথ বলে। কেউ কেউ আবার বলে কারবালা থেকে বেঁচে ফেরা হোসেনপুত্র জয়নাল আবেদীন পরবর্তীতে যে পুস্তক রচনা করেছিলেন সেখানে নাকি কারবালার উল্লেখই নেই, বরঞ্চ আছে এজিদের প্রশংসা!

[দুলদুল ঘোড়ায় নারীর অবয়ব]

[২৩ এপ্রিল তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত ও মেঘচিল ওয়েবজিনে পুনর্মূদ্রিত]

comments powered by Disqus