মরিচঝাঁপি: ধর্মের বলি বিচ্ছিন্ন বাঙালির করুণ পরিণতির ইতিহাস

মরিচঝাঁপি: ধর্মের বলি বিচ্ছিন্ন বাঙালির করুণ পরিণতির ইতিহাস

১.

খুব গ্লানি নিয়েই বলছি, কিছুদিন আগে পর্যন্ত মরিচঝাঁপির নামটা পর্যন্ত জানতাম না। ধর্মের কারণে দেশভাগ, নির্যাতন, তারপর লাখে লাখে বাঙালির দেশত্যাগ, পশ্চিমবাংলায় উদ্বাস্তু জীবন… এগুলো জানতাম। যারা অবস্থাপন্ন, তারা বাড়ি বদল করেছেন। কিন্তু দেশভাগের বলি হওয়া সিংহভাগই তো নিচু[!]জাতের, তারা আবার মানুষ নাকি[!]? তারা তো নমশূদ্র…

তাই পশ্চিমবঙ্গের পথে ঘাটে, রেল স্টেশনে শুরু হয় তাদের উদ্বাস্তু জীবন। সরকারের কৃপায়। আরো বেশি কৃপা করতে ভারত সরকার তাদের পাঠিয়ে দেন কালাদরিয়া পার করে আন্দামানে আর দণ্ডকারণ্যে।

এই পর্যন্ত জানা ছিলো। ধরেই নিয়েছিলাম অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো।

কিন্তু জানা ছিলো না, দণ্ডকারণ্যে প্রায় দুই যুগের অমানবিক অসহনীয় জীবন থেকে বাঙালিরা আবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন, এসেছিলেন নতুন সরকার বামফ্রন্টের আমন্ত্রণে।

[মধুময় পাল সম্পাদিত ’মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ ছিন্ন ইতিহাস’ বইয়ের প্রচ্ছদ]

আর তারপর মরিচঝাঁপি ট্র্যাজেডি। বাংলাদেশ সংলগ্ন সুন্দরবনের দ্বীপ মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুদের তাড়াতে জ্যোতিবসুর সরকারের নির্মম অভিযান। রাতের আঁধারে গোটা দ্বীপে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, আগুন, হত্যাকাণ্ড… সেই অভিযানে কতজন অসহায় বাঙালির মৃত্যু হয়েছিলো আজো পর্যন্ত কেউ তা জানে না!

এসবের কিছুই জানা ছিলো না।

জানা হতোও না, যদি মধুময় পাল সম্পাদিত, গাঙচিল প্রকাশিত বই “মরিচঝাঁপি, ছিন্ন দেশ ছিন্ন ইতিহাস” না পড়তাম।

২.

অন্য বই খুঁজতে গিয়েছিলাম আজীজে। চোখে পড়লো ‘মরিচঝাঁপি’ নামে এই বইটি। ভাবলাম উপন্যাস। ফ্ল্যাপ পড়ে বুঝলাম উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বই। তখনো কিছুই বুঝতে পারিনি। ভারতীয় বইয়ের দাম এখন গায়ের মূল্যের দ্বিগুন। তাই পারতপক্ষে কিনি না। কিন্তু বইটার গেটাপ মেকাপ দেখে খুব ভালো লাগলো। কিনে নিলাম। তারপর অন্য অনেক বইয়ের মতো এটাও জমে থাকলো।

সেদিন কী মনে করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তারপর গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম বইটা। বহুদিন পরে কাজ আর ইন্টারনেট বন্ধ রেখে শুধু বই পড়েই কাটালাম দুটো দিন।

৩.

দুই যুগের উদ্বাস্তু জীবন শেষে এপার বাংলা থেকে যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশ লাগোয়া সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে শেষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। নির্বাচনে জেতার জন্য উদ্বাস্তু বান্ধব জ্যোতি বসুর দলই তাদের ডেকে এনেছিলো। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই তারা ভুলে গেলো প্রতিশ্রুতি। লাখ খানেক উদ্বাস্তুকে ফেরত পাঠালো দণ্ডকারণ্যে। কিন্তু হাজার চল্লিশেক তবু রয়ে গেলো মাটি কামড়ে। বাঘের কামড় খাবে, তবু দণ্ডকারণ্যে ফিরে যাবে না। দুর্গম দ্বীপ মরিচঝাঁপিতে বসতি গাড়লো তারা। সরকারকে সাফ জানিয়ে দিলো, কোনো সাহায্য লাগবে না, শুধু বাধা না দিলেই খুশি।

নিজেরাই সেখানে গড়ে তুললো জনপদ। রাস্তা তৈরি করলো, নদী থেকে মাছ ধরে খায়, বড় মাছ পেলে পাশের বাজারে বিক্রি করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তায় নিজেরাই স্কুল বসালো। স্বপ্ন দেখলো নতুন করে।

কিন্তু জ্যোতি বসুর সইলো না, চালালো নারকীয় তাণ্ডব। বামফ্রন্টের শরীকদলের নেতাই যাকে বর্ণনা করেছেন ‘জালিয়ানওয়ালাবাগকেও হার মানানো তাণ্ডব’ বলে!

বাঘ নয়, বামফ্রন্ট সরকারই খেলো তাদের। রাতের আঁধারে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো মরিচঝাঁপি থেকে। পাঠিয়ে দেওয়া হলো দণ্ডকারণ্যে আবার। আর সেই রাতের আঁধারে কতো লোক মারা পড়লো তা কেউ জানে না। অভিযোগ আছে বস্তায় করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টাইগার প্রজেক্টে, বাঘের খাদ্য হিসেবে। আর বাকীগুলো ফেলে দেওযা হয় গভীর সমুদ্রে।

“মরিচঝাঁপি, ছিন্ন দেশ ছিন্ন ইতিহাস” সেই নৃশংসতার প্রামাণ্য দলিল।

৪.

উদ্বাস্তুরা যখন মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তখন পশ্চিমবঙ্গের বাবুরা অনেকেই জানতেন না এসব খবর। কিন্তু অনেকেই জানতেন, খবর রাখতেন। শঙ্খ ঘোষ একাধিক কবিতা লিখেছেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাধিকবার সশরীরে গিয়েছেন মরিচঝাঁপিতে, আনন্দবাজারে লিখেছেন তাদের দুর্দশার কথা। অনেক সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মীও ছিলেন উদ্বাস্তুদের পাশে।

কিন্তু জ্যোতি বসু সরকার একাই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন।

সম্পাদক মধুময় পাল কিছুই করেননি, কিন্তু অসাধারণ কাজটাই করেছেন। ঐ আমলে এবং পরে মরিচঝাঁপি নিয়ে যা যা লেখা প্রকাশ হয়েছিলো, সবগুলো জড়ো করে তুলে দিয়েছেন ৩৫৯ পাতার এই বইতে। যেখানে সরকারী প্রেসনোট, জ্যোতিবসুর ততোধিক সরকারী ভাষণ, পুলিশ কমিশনারের মিথ্যাচার থেকে শুরু করে সব লেখাই অবিকল ঠাঁই পেয়েছে। পাঠককে সত্যটুকু খুঁজে বের করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না।

৫.

৭০ দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও মরিচঝাঁপির কথা হারিয়ে যাচ্ছিলো। চলতি দশকে আবার মরিচঝাঁপি চলে আসে সামনে। জ্যোতিবসু সরকারের দীর্ঘ ইতিহাসে প্রথম ম্যাসাকার মরিচঝাঁপি। ১৯৯৯ সালে এশিয়ান স্টাডিজের জর্নালে রস মণ্ডলের লেখা ‘Refugee Resettlement in Forest Reserves: West Bengal Policy Reversal and the Marichjhapi Massacre’ আর নিরঞ্জন হালদারের ‘মরিচঝাঁপি: নৈঃশব্দ্যের অন্তরালে’ বইটিই মরিচঝাঁপিকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে।

[লেখক অমিতাভ ঘোষ]

[’দ্য হাঙড়ি টাইড’ বইয়ের প্রচ্ছদ]

আর নজর কাড়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ যখন ২০০৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘The Hungray Tide’ এ পটভূমি হিসেবে সুন্দরবন ও মরিচঝাঁপির কথা তুলে ধরেন।

[মরিচঝাঁপি গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া দুজন- জ্যোতির্ময় মন্ডল ও সন্তোষ সরকার]

৬.

ধর্মের বলি হওয়া লাখো বাঙালির কান্নার বই মরিচঝাঁপি, জ্যোতিবসু সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা আর নৃশংসতার বই মরিচঝাঁপি, বাঘের মতো মনোবল নিয়ে তবু বেঁচে থাকা বাঙালির বার বার মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার বই মরিচঝাঁপি, আমাদের খুব অন্তর্গত বেদনা, কান্না আর লজ্জার বই মরিচঝাঁপি।

ধর্মের বিচারে আমরাই তো আমাদের প্রায় দশ বারো লাখ মা ভাই বোন পিতাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম পাশের দেশে। সেই দেশ যে তাদের জন্য তাসের দেশ হয়ে উঠলো, সে খবর আমরা কতটুকু রেখেছি? তাড়িয়ে দিয়েই কি কর্তব্য শেষ করিনি?

[গুগল ম্যাপে মরিচঝাঁপির অবস্থান, হ্যামিল্টন আইল্যান্ড]

৭.

মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ, ছিন্ন ইতিহাস

সম্পাদক: মধুময় পাল

প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৯

প্রকাশক: গাঙচিল

মূল্য: ২৭৫ [ভারতীয় মূদ্রা]

[২৩ জুলাই ২০১০ তারিখে সচলায়তনে প্রকাশিত]