শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল

শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল

তখনো গ্লোবালাইজেশনের জোয়ারে আর মুক্তবাজার অর্থনীতির দামে বিকিয়ে যায়নি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিগুলো। তখনো পাড়ায় মহল্লায় ছিলো সাংস্কৃতিক, শিশু, ক্রীড়া আর সাহিত্য সংগঠনগুলো। ১৬ ডিসেম্বরে বড় রাস্তার মোড়ে স্টেজ সাজিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর বার্ষিক নাটক হতো। মহল্লার ছোট্ট সোনামনিটা কারার ঐ লৌহকপাট গাইতে গিয়ে ভুল করে লৌকহপাট বলে ফেললে আমরা সবাই খুশিতে হাততালি দিয়ে দিতাম। আর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হতো পত্রিকা, সুবাদে মহল্লার সবাই বছরে একবারের জন্য কবি সাহিত্যিক হয়ে উঠতো। কাঠখোট্টা করিম সাহেব, হাড় কিপটে জামালউদ্দিন, লাজুক হোসনে আরা বেগম, ভীষণ রঙবাজ বাবু ভাই, বেণীদোলানো শিউলী বেগম… সকলেই ঘাম ছুটিয়ে দিতো কবিতা গল্প ইত্যাদি লিখতে।

স্কুলে পড়ি তখন, পাঠ্যপুস্তক ছুঁয়ে দেখিনা, অপাঠ্যপুস্তক সব মুখস্ত। স্কুলের নীল প্যান্টের পকেট বানানো হয় সেবা প্রকাশনীর বইয়ের মাপে। ভুগোল বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে নিকোলাই গোগল।

মহল্লার পত্রিকার ঠিকাদারী যথারীতি বড় ভাইদের হাতে, আমাদের হাতে শুধু পেন্সিল। আমাদের তখন কিশোর বেলা, আমাদের তখন ষোলো। নিজের মতো পত্রিকা প্রকাশের সাধ হলো।

মহল্লার সব ’লেখকেরা’ যথারীতি বড় ভাইদের পত্রিকায় লিখবেন, আমার পত্রিকায় লেখার তো কেউ নেই। বন্ধু আলী হোসেনকে নিয়ে এক সকালে সোজা হাজির হয়ে গেলাম সুফিয়া কামালের বাড়িতে। কেউ তাড়িয়ে দিলে না এই ভাগ্য। বইয়ে ঠাঁসা বড় একটা বৈঠকঘরে বসতে দিলো। শীতল জলে জুড়াইলো প্রাণ, কিন্তু পরক্ষণেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। কোত্থেকে এক নরম তুলতুলে বিদেশী সফেদ সারমেয়ছানা এসে হাজির। আমার কুকুরভীতির কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু সেই কুকুরটা তা জানলে তো! তার যাবতীয় মনোযোগ যেন আমাকেই কেন্দ্র করে। ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম সোফায়। কিছুক্ষণ পর এলেন একজন বৃদ্ধ শিশু… সুফিয়া কামাল!

মহল্লার সামান্য পত্রিকা, সম্পাদক এক সামান্যস্য সামান্য কিশোর ছেলে, তাও সে পত্রিকা আদৌ বেরোবে কি না তার নেই ঠিক, কারন এখনো এক টাকাও জোটেনি বিজ্ঞাপন বাবদ। মহল্লার আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি থেকে চালের আড়ত সবার কাছেই যাওয়া হয়েছে, কিন্তু সকলেই বড় ভাইদের পত্রিকাতে চাঁদা দিতে উদগ্রীব। যার এখনো গোঁফ ওঠেনি ঠিকমতো, সেই ছেলে একটা পত্রিকা বের করে ফেলবে তা সম্ভবত কেউই বিশ্বাস করেনি।

কিন্তু বিশ্বাস করেছিলেন সুফিয়া কামাল। একেবারে অচেনা একটা কিশোর ছেলে কোনোরকম পূর্ব যোগাযোগ বা যোগ্যতা ছাড়া হাজির হয়ে কবিতা চেয়ে বসলে তিনি সস্নেহে বলেছিলেন পরের সপ্তায় আবার যেতে। এবং পরের সপ্তায় আবারো দুরু দুরু বুকে হাজির হলে সেই কিশোর অবাক হয়ে দেখে এই ভীষণ ব্যস্ত মানুষটি, যাকে অন্তত একশটা সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে হয় পথে ঘাটে আন্দোলন সংগ্রামে… তিনি একটুও ভুলে যাননি সেই কিশোরের কথা! সম্পূর্ণ নতুন একটি কবিতা লিখে রেখেছেন দেবেন বলে! সামনে দাঁড়াতেই সেই কিশোরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিশুদের বাংলা লেখার রুলটানা খাতায় লেখা আনকোরা নতুন একটা কবিতা!

প্রথমে বিশ্বাস হয়নি যে সত্যি সত্যিই তিনি কবিতা দিয়েছেন! অবিশ্বাসে চেয়েছিলেম। কী কথা হয়েছিলো এতোবছর পর আর মনে নেই। শুধু মনে আছে ধানমন্ডী ৩২ নম্বরের সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে ধানমন্ডী লেক, যেটা তখনো এখনকার মতো এতো ইঁট-কাঠ-লোহায় ঢেকে যায়নি… সেখানে গিয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ।

শেষ পর্যন্ত শতিনেক টাকা জুটেছিলো কোত্থেকে কোত্থেকে জানি। মহল্লার প্রান্তে বাবু ভাইয়ের প্রেসে ছাপতে দিয়ে দিনরাত বসে থাকি প্রবল উত্তেজনায়। লেটারহেড প্রেস। কাঠের ছোটো ছোটো বাক্স, তার ভেতরে লুকিয়ে আছে শীশার তৈরি হাজার হাজার রুপোলী অক্ষর। ঝড়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে কম্পোজিটর সেগুলো তুলে তুলে সাজাচ্ছেন আর পাশে বসে অবাক চোখে দেখছে এক কিশোর।

খুব শখ করে নিজেই একটা প্রচ্ছদ এঁকেছিলাম, কিন্তু ব্লক বানানোর টাকা ছিলো না। সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুর্মর কবিতার চারটে লাইন পরপর সাজিয়ে প্রেসের মালিক নিজেই একটা প্রচ্ছদ করে দিলেন। তাতেই খুশি ধরে না!

মাত্র তিনশ টাকা খরচায় লেটারহেড প্রেসে ছাপানো একটা পত্রিকা, তার সামান্য এক সম্পাদক, কিন্তু ভেতরে ছিলো অসামান্য কয়েকজন লেখকের লেখা… যার মধ্যে একজন সুফিয়া কামাল!

শুভ জন্মদিন মহিয়সী নারী! শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল!

আপনার কোনোদিনই জানা হয়নি রুলটানা খাতার ভেতর কবিতার নামে সেদিন আপনি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন এক সাহসের বীজ, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা! যা এখনো বাঁচিয়ে রাখে আমাকে, সাহস দেয় সবগুলো সঙ্কটে।

জন্মদিনে আপনাকে অসীম শ্রদ্ধা!

comments powered by Disqus